কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত




কান্দে কানাই বাজেয়া রে সানাই

খোকা বর্মন সানাই বাজায়। খোকা বর্মন হাতঘড়ি-প্যান্ট-সার্ট লুঙ্গি এসব কিছুই পড়ে না। পাজামা ও ফতুয়া পরে। খোকা বর্মন নদী ভালোবাসে। আর নদীর পর নদী পেরিয়ে সে নদীপথেই ফিরে আসে। ঘর বানায়। সংসার বানায়। বানায় নাকি নির্মাণ করে! আবার নির্মাণ করে বলেই খোকার একটা বসতবাড়ি হয়। খোকা বর্মন সানাই  বাজায় এটা কোনো ঘটনাই নয়। কেননা পৃথিবীতে হাজার হাজার সানাই বাজানেওয়ালা মানুষ আছে। তবু খোকা বর্মন সানাই বাজায়
এটা একটা ঘটনাই। ঘটনার সাথে তুরন্ত জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-দশটি গ্রাম। মানুষজন। খোকা বর্মনের সানাই ছাড়া সেইসব গ্রামে কোনো বিয়ে হবে না, অন্নপ্রাশন হবে না, লোকদেবতার পুজো  হবে না। মাটির গভীর থেকে সানাই-এর সুর উঠে আসে। আর উঠে এসেই সেই সুর কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে না। খোকার এমনই যাদু যে সুর প্রথমে স্বল্পগতির দৌড় লাগায়। এরপর ক্রমাগত গতিশীল হয়। গতিশীল দৌড় একটা বহুরৈখিকতা অর্জন করে। অর্থাৎ সানাইয়ের সুর ছড়িয়ে পড়ে মাঠ প্রান্তর নদী বসতবাড়ি বৃক্ষরাজি বালক বালিকা মেঠোপথ যাবতীয় গ্রাম্য অনুষঙ্গের ওপর দিয়ে। ওপর দিয়ের মানে বদলে ভিতর দিয়ে বা মধ্য দিয়েও হয়। খোকার সানাই বাদন আবার নাচগান ভুলতে বসা গ্রামের মেয়ে-বউদের টেনে নিয়ে আসে চিরাচরিত বিবাহনাচের কাছে। অর্থাৎ আনন্দের  কাছে। খোকার সানাই টুকরো চাঁদের নিচে ঝুলে থাকে। ঝুলে থাকলেও সানাইকে মোটেও দোলনা অথবা মই মনে হয় না। মনে হয় না কেননা খোকার সানাই  অপদেবতার পুজোতে বাজে, বাজতেই থাকে অথচ আমাদের গা ছমছম বা ভয় ভয় কিছুই করে না। খোকা কি জানে বা টের পায় বা বোঝে পৃথিবীতে মেয়েদের জীবন আদতে কষ্ট আর কান্নার জীবন! সেই সানাই শুনে অনেক মেয়েই আবার কান্নাতেই  মুখ ঢাকে। কেননা সেই কান্না প্রকৃতই কান্না নয়। তা আসলে বিড়বিড় করে কথা বলে, মেয়েদের নিজস্ব ভাষায়।




হস্তীকইন্যা

কাষ্ঠ নির্মিত ঘরবাড়ির প্রতি আবাল্য আকর্ষণ আমারআমার বাল্যকালের অনেকটা কেটেছে কাঠের বাড়িতে। কাঠের সব বাড়ি ঘরের মাঝখানেএবং আজ কানে বাজে পিতামহর কাঠের খড়মের শব্দআবার ঝরনার পাশে ঝোরার কাছে কাঠের বাড়িকাঠের বাড়ি মানেই জঙ্গল আর জঙ্গলজঙ্গল থেকে হাওয়া আসোওয়া এসে ঢোকে কাঠের বাড়ির মধ্যে কাঠের বাড়ির সামনে দিয়ে উত্তরের হাতির পাল দলবেঁধে যায়আবার কাঠের বাড়ির কাঠের বারান্দা থেকে কেউ কেউ হাতিমিছিলের ছবি তোলেতবে বনবাংলো এবং কাঠের বাড়ি কখনো এক নয়যদিও উভয়ই কাঠ দিয়ে নির্মিতবনবংলোতে প্রবেশের জন্য ভ্রমণোপযোগী বিকেল দরকারআর বর্ষাকালের  ভেতরে আকুল হয়ে থাকে আমাদের কাঠের ঘরবারি তরাই ডুয়ার্সএ এখনও কত কাঠের বাড়ি। ছড়ানো ছিটানো। কাঠের বাড়ি আমাদের স্বপ্নঝাঁপি। স্মৃতিকাতর করেআমার কবিতায় খুব চলে আসে কাঠের বাড়ি বাড়ির সামনে চিলতে মাঠ। নাবাল জমির ঢাল। কাটাগাছ বনতুলসী। কবিরা আসেন এখানে নদী পেরিয়ে। ছবি আঁকবার লোকজনওআর সকলে সিঁড়ি ভেঙেই কাঠের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর তারা তো ঢুকেই আর চুপচাপ বসে থাকে না! মানে বসে থাকাই যায় না। কাঠের ঘরবাড়ি আবার নিসর্গপ্রীতি জাগায় তখন একা একাই গান ধরাএকা একাই হাততালিকাঠের বাড়ির তৈলচিত্রে পাখিদেরও দেখা যায়খুব মনখারাপের দিনে আমি কাঠের বাড়ির স্বপ্নে ডুবে থাকি স্বপ্নে কাঠের বাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে কাঠের খড়ম, কাঠের আরামচেয়ার, ভ্রমণলাঠি ও কাঠের সিঁড়িঅথবা সিঁড়িটাকে বাদ দিয়ে বা ঠেলে সরিয়ে দেওয়াও যায়, কেননা সিঁড়ি তো কাঠের বাড়িরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ



 

বৃষ্টি
পুরাণ

দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল এটা সত্যি সত্যি দিদির মৃত্যুও। বৃষ্টি হচ্ছিল তবে সেটা জোরালো বা ধারালো বৃষ্টি নয় বৃষ্টি থামছিল আবার শুরু হচ্ছিলঅথবা বৃষ্টি টেনে নিয়ে যাছিল বৃষ্টিকে। আচ্ছা ‘টেনে নিয়ে’ কাটছাঁট করে লিখি বরং ‘নিয়ে যাচ্ছিল’বৃষ্টি তবে কোথায় যায়! যায় বললেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগেফাঁকা ফাঁকা মানে মহাশূন্যতার একটা বোধ অনুভূতি। কবিতা লেখার সময়কালে  এমনকি পড়বার সময়ে বা রিক্সায় চেপে একা একা ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তেও ফাঁকা ফাঁকা অবশ্যই ভাবায় ভাবায় এবং দীর্ঘ ভাবনার পরেও আমার শূন্যতাটা সরে নাসরে না তাই পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আমি পাথর গড়িয়ে দিই। গড়িয়ে দিই একারণে অনুতাপ হয়ই না কোনোশহরের শীত সহজেই যুক্ত করে নেয় সার্কাসের তাঁবু জোকারের হৈ-হল্লা রাজহাঁসের ডাক ঘোড়াদের মৃদু মেদুর সমবেত হাসি - এইসব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সার্কাসের প্রসঙ্গে প্রসঙ্গ এমন জিনিস বারবার বদলে যাওয়া যার স্বভাবধর্মবদলে যাওয়াটা যথাযথ শোনাবে যদি বলি অবস্থানবিন্দুর  ঘো্রাফেরা, চলাচল চলাচল এবং ঘোরাফেরা চমৎকার ছবি টাঙিয়ে দেয় একজন পর্যটক একাধিক ধর্মযাজক ও অজস্র হাটফেরত জনতা সমুদয় অনুষঙ্গ এসে বসে পড়ে টাঙিয়ে দেওয়া সেই ছবিতে, আর এক নদী থেকে বেরিয়ে আসা আরো এক নদী থাকলে তৎসহ বেরিয়ে আসা নদীর ঢালু জুড়ে যদি কিছু উড়ন্ত পাখির ঝাঁক টেনে আনা যায়, তাহলে সন্দেহাতীতভাবে উপহারযোগ্য ছবি হয়ে উঠবে, সেটা আর  কথাপ্রসঙ্গে চলাচল ও ঘোরাফেরা মুদ্রাদোষের মতো ঘুরে ফিরে আসবে। যেমন কত কত শব্দ রোজদিন ঘুরেফিরে আসেআর তাদের অধিকাংশই ঘরে ফিরে চলে যায়। চলে যাওয়াটা সামান্য মর্মাহত করে আবার উৎফুল্লও চলে যায় বলেই তো আবার খুঁজতে শুরু করি!  





সমাপ্তিসঙ্গীত

হেরম্বচরিত শেষ হয়ে গেল। কিন্তু হেরম্ব তো থামবে না! সে তার মতোন করে এই  উত্তরজনপদের বাড়িটাড়ি হাওড়হাওয়ায় অতিজীবিত থাকবে। কত কত মানুষজন মেলাটেলা গানবাড়ির ভিতর দিয়ে যেতে যেতে হেরম্ব শেষাবধি প্রজন্মপ্রেরিত ইতিহাস হয়েই থেকে যাবে, তাকে থেকে যেতেই হবে। এইভাবে কি আসলে মহামহিম কোনো  আখ্যানের ব্যপ্তির পরিসীমায় জীবনকে ধারণ করে থাকবে সে! না কি মিথের ভিতর, মিথের গায়ে হেরম্ব বারবার মিশিয়েই দিতে থাকবে মিথের পর মিথ!









0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন