কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

তুষ্টি ভট্টাচার্য

মুক্তি 




একটা চেয়ারের গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাঠিকালো চশমাটা চেয়ারের ওপর পড়ে আছেএক ভাঙাচোরা স্যাঁতসেঁতে বারান্দায় এভাবেই চেয়ারটা দীর্ঘকাল বসে আছেমেহগিনি কাঠের চেয়ারটায় এককালে পালিশের রমরমা ছিল, এখনও কালচে হয়ে যাওয়া ছাপে তার প্রমাণ মেলেএই চেয়ারের মালিক বা মালকিন অন্ধ, না বলে দিলেও কালো চশমা আর লাঠি তার প্রমাণ দিচ্ছে। অথচ উনি জন্মান্ধ না। সে কথা জানে ওই বারান্দাযে বারান্দারও কৌলীন্য ছিল কোনোকালেবারান্দার ফাটা টাইলসগুলো দেখলে যে কো্নো অভিজ্ঞ চোখ বলবে, ওগুলো ব্র্যান্ডেড  ইতালিয়ান। যে বাড়ির অংশ এই বারান্দা, তাকে অনায়াসেই হানাবাড়ি বলে চালানো যায়এই বাড়ির মুখ্য চরিত্র এই বারান্দা, যার গায়ে আলোর গন্ধ এখনও লেগে আছে মমির মতো 


জন্মান্ধ যিনি ছিলেন না, ফ্ল্যাশব্যাকে তাঁর আলোয় ফিরে যাওয়া যাক এই ফিরতে গিয়ে হয়তো অনেকটাই পেছতে হবেটাইমমেশিন সেই পেছন ফেরার হিসেব রাখে  নাগুঁড়ি মেরে একটা অন্ধকার গুহা দিয়ে যাওয়ার সময় যেমন পাথরের দেওয়ালের গা থেকে গোপন ঝর্ণার জলের ছিটে লাগে, পেছনে যাওয়ার অনুভূতিটা সেরকমই হবে আশা করা যায়গুহামুখ থেকে ক্রমশ ভেতরে আরও ভেতরে যাওয়ার সময় এক ঠাণ্ডা ঝলকে ডুব দিতে হবে, এটা মেনে নিয়েই এই যাওয়া কিংবা ফেরা। 

সে মানুষটি কোনো এক সময়ে নির্দিষ্ট মুহূর্তে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেনসে দাঁড়ানোর মধ্যে এক আপাত ক্যাজুয়াল ভাব ছিল। আলগোছে বারান্দার রেলিঙে ঝুঁকে,  চারিদিকে চোখ বোলাতেন। হাতে থাকত চা বা কফির মাগএক এক করে ধীর চুমুকে অনেকখানি সময় নিয়ে চলত তাঁর চা/কফি পানএরপর তিনি আরাম করে  বসতেন সেই মেহগিনি কাঠের ঝকঝকে চেয়ারে। সকাল বিকেল কী রাত, যখনই  তিনি পা দিতেন সেই ইতালিয়ান টাইলসের মেঝেতে, টাইলসগুলো তাঁর পায়ের শব্দে ঘুম থেকে উঠে বসতআলতো করে ওরা তাঁর পায়ে চুমু খেত, কখনও বা হাত বুলিয়ে দিত
    
ঋতু আসে, ঋতু যায়বারান্দা আর চেয়ার নিয়ে মানুষটি কাটিয়ে দে পালাবদলযেমনভাবে আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে, বিদ্যুৎ চমকায়, বৃষ্টি নামে, তেমনভাবেই হঠাৎ এক অজানা নীল বিদ্যুতে তড়িতাহত হলেন তিনি। বারান্দা, চেয়ার, টাইলস, রেলিং সব দেখল, বুঝলএই নতুন নীল মানুষটি তাদের সাথে আজকাল অনর্গল কথা  বলেচা জুড়িয়ে আসে কথা বলার তোড়ে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল সন্ধ্যে আর তারপরে রাত – কথা, কথা শুধু কথা। এই কথার স্রোত আলো ঢেকে দেয়, এই স্রোত বৃষ্টিতে মিশে ঘুরে ঘুরে নাচেরাতচরা পাখির মতো সব কথারা ঢেকে দেয় আকাশ


এই নীল মানুষের কী যে এত কথা, কে জানে! একটা সময় পরে দেখা যায় এই সব  এত এত কথারা ক্রমশ একা হচ্ছেকথা শুনছে না কথাপ্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে বারান্দায়বারান্দার টাইলসে ফাটল ধরছে এক এক করে এই শব্দের অভিঘাতে। রেলিং নুয়ে পড়ছে। চেয়ারের হাতলে, পায়ায় কাঁপ ধরছেআকাশের ঘোলা রং দেখে নীল মানুষটি তাঁর সব রং দিয়ে দিতে চাইলেন আকাশকে। দিলেন  বটে, কিন্তু আকাশ ছুঁড়ে ফেলে দিল তাঁর সমস্ত দেওয়া। কালো হতে থাকল বারান্দা,  চেয়ারসব আলো মুছে গিয়ে চাপ চাপ কালো ঠুসে দিল কে যেন তাঁর চোখে। আহ, বড় তীব্র এই অসুখ! নিচের তলা থেকে এক কালো চশমা উড়ে এলো তাঁর কোলে বাড়ির পাশে দাঁড়ানো গাছটি লাঠি হয়ে উঠে এলো তাঁর হাতে


স্যাঁতসেঁতে বারান্দায় চেয়ারে চুপ করে বসে থাকেন এখন তিনিকালো চশমার আড়ালে তাঁর চোখ কি কিছু বলে? বারান্দা বোঝে না, টাইলস জানে নামাঝে মাঝে হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকঠুক করে পায়চারী করেন আর ভাবেন, একেই কি মুক্তি বলে? এই যে বাইরের পৃথিবীর আলো, বৃষ্টি তাঁর চোখ দেখতে পাচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছে না তাঁর নিজস্ব বারান্দাটিকে; ভালো লাগা, মন্দ লাগার বোধ থেকে  নিষ্কৃতি পেয়েছে মন, এই কি মুক্তি? এক অদ্ভুত স্থিরতা তাঁকে ছেয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে, শান্ত হতে হতে তাঁর মনন পৌঁছে যাচ্ছে অনন্ত সাগরের দিকেচোখ বুজলেই তিনি ঢেউয়ের ওঠাপড়া দেখছেন, ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনছেন, বালি মাখা নোনতা হাওয়া তাঁর গাল ছুঁয়ে যাচ্ছেপালকের মতো শরীর নিয়ে তিনি ভাসতে ভাসতে চলে  যাচ্ছেন সাগরের কোলে কখনও বা পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন আকাশের বুকেসময়  এগোবার আগেই তিনি বুঝে গেলেন, সেই চরম প্রত্যাশিত মুক্তি তাঁর হাতের মুঠোয়শুধু হাত বাড়ানোর অপেক্ষাটুকু লেগে আছে সেই লাঠির বাঁটে

একটু সময় নিলেন তিনি। কালো চশমা পড়ে রইল চেয়ারে, লাঠি ছাড়াই ঘরে গেলেন। বারান্দা অপেক্ষায় রইল, চেয়ার ঝিমোতে লাগল, টাইলসগুলো ঝনঝন করতে করতে ফেটে যেতে লাগল, আর লাঠির ডগায় লেগে থাকা মুক্তি অভিমানে ফিরে গেল শেষে। এই বারান্দা, রেলিং, চেয়ার, কালো চশমা আর লাঠি সেই থেকে অপেক্ষায়, কখন তিনি ফের আসবেন এই বারান্দায়!              

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন