কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

অদ্বয় চৌধুরী

ফ্রম জেমস বন্ড, উইথ ইডিওলজি




প্রথম পর্ব

কাল্পনিক চতুর্ভুজ



“স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে”

‘কলকাতার যীশু’মাঝখানের দু’টি লাইন। সমগ্র বিতাটি থেকে শুধুমাত্র এই দুটি লাইনের নিপুণ প্রস্থচ্ছেদ ঘটিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রাখা হলে চারটি মূল উপাদান ভেসে ওঠে আতসকাচে: ‘বাস’, সেই বাসের ভিতরে অবস্থিত এক ব্যক্তি, বাসের বাইরে দ্রষ্টব্য ‘আকাশ’, এবং ‘তুমি’-সম্বোধিত আর এক ব্যক্তি। এখন, প্রশ্ন হচ্ছে এই চারটি উপাদানের নিজস্ব পরিচিতি কি? এরা কি শুধুই অর্থহীন কতকগুলি বস্তু? বা ধারণা? এদের কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক আছে? এখানে, এই খণ্ডিত কাপলেটে, একজন দর্শক আছে। সে একটি বাসের ভিতর থেকে বাইরের কিছু দৃশ্য দেখছেবাস অবশ্যই গতিময়তাকে অথবা সম্ভাব্য গতিময়তাকে ইঙ্গিত করে। গতিময় বা সম্ভাব্য গতিময় পরিবেশের বাইরে, দর্শক-ব্যক্তির আপাতনিশ্চল, স্থবির দ্রষ্টব্য বিষয় হিসেবে রয়েছে আরও দু’টি উপাদান: ‘আকাশ’ এবং ‘তুমি’-সম্বোধিত ব্যক্তি। ‘তুমি’-সম্বোধিত ব্যক্তির কোনো পরিচয়, অবস্থান বা তার স্থবিরতা বা গতিময়তা সম্বন্ধেও কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। ধরে নেওয়া যেতে পারে তার পরিচয়, অবস্থান সব কিছুই ধরা পড়ে শুধুমাত্র দর্শক-ব্যক্তিটির চোখে — তার মাধ্যমে, তার নিরিখে। বাকি পড়ে রইলো ‘আকাশ’ যা এক বিশাল পটভূমি হিসেবে উপস্থিত। ওই সুবিস্তৃত বিশালাকার পটভূমির সামনে অন্য দ্রষ্টব্য বিষয় ‘তুমি’-সম্বোধিত ব্যক্তিটি অবস্থান করে। দর্শক-ব্যক্তি একবার পটভূমি ‘আকাশকে’ দেখে, একবার ‘তুমি’-সম্বোধিত ব্যক্তিকে। মনে হয়, ‘আকাশের’ প্রেক্ষিতেই সে যেন ‘তুমি’-কে দেখছে। সর্বব্যাপী পটভূমি আকাশ গতিময় না হলেও পরিবর্তনশীল। তবে, তার বিশালতার কারণে তাকে আপাতস্থবির মনে হয়। এছাড়া আরও একটি ছোট উপাদান পাওয়া যায়: জানালা। জানালা বা একটি ফ্রেম, ‘বাহির’ এবং ‘ভিতর’-কে বিচ্ছিন্ন করে, ‘দর্শক’ ও ‘দ্রষ্টব্য’-কে আলাদা করে, ‘চিত্রকর’ ও ‘চিত্র’-কে বিভাজিত করে

জ্যামিতিক বন্টনে এই চারটি উপাদানকে ভাগ করলে এরকম একটি চিত্রকল্প উঠে আসতে পারে: ‘দর্শক-ব্যক্তিটি’ হলো ‘লেখক’, ‘বাস’ হলো তার ‘চিন্তাধারা’ যা  তাকে চালনা করে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই ‘চিন্তাধারাকেই’ দর্শনের ভাষায়  ‘ইডিওলজি’ বলা যেতে পারে। ‘তুমি-সম্বোধিত ব্যক্তিটি’ হলো লেখক-সৃষ্ট ‘চরিত্র’। লেখক-সৃষ্ট ‘চরিত্রের’ নিজস্ব পরিচয়, অবস্থান ইত্যাদি থাকে না; ‘চরিত্র’ ধরা পড়ে কেবল মাত্র লেখকের মাধ্যমে, লেখকের নিরিখে। এবং ‘আকাশ’ হলো ‘ইতিহাস’—  সর্বব্যাপী পটভূমি। লেখক একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পটভূমিতে একটি চরিত্রকে দেখে, চরিত্রকে রূপ দেয়। ঐতিহাসিক পটভূমি পরিবর্তনশীল। তবে তার গতি ভীষণ মন্থর। সেক্ষেত্রে, পরিবর্তিত ঐতিহাসিক পটভূমিতে চরিত্রের মাত্রাও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। এই পারস্পরিক সম্পর্কবিন্যাসকে একটি গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিলে আমরা একটি চতুর্ভুজের আভাস পাই। চারটি বাহু যথাক্রমে ‘লেখক’, ‘ইডিওলজি’, ‘চরিত্র’ ও ‘ইতিহাস’। এবার প্রশ্ন হলো, এখানে দর্শক- ব্যক্তিটি, অর্থাৎ ‘লেখক’, একটি ‘স্টেট’ বাস দ্বারা বাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ নিপুণ জ্যামিতিক পরিমাপে বোধহয় এটাও বলে দেওয়া যায়, যে নির্দিষ্ট ইডিওলজি লেখককে সম্মুখে চালনা করে তা হলো রাষ্ট্রীয় ইডিওলজি!


‘লেখক’, ‘ইডিওলজি’, ‘চরিত্র’ ও ‘ঐতিহাসিক পটভূমিকে’ চারটি বাহু ধরে নিয়ে যে কাল্পনিক চতুর্ভুজ আঁকা হলো তা নিয়ে কোনো জ্যামিতিক প্রশ্ন উত্থাপিত না  হলেও দার্শনিক প্রশ্ন, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি হাত তুলে উঠে দাঁড়াতেই পারে। বিশেষত, ‘ক্যাননিক্যাল টেক্সট’, বা ‘হাই লিটারেচার’-এর ক্ষেত্রে নানা রকম দার্শনিক প্রশ্ন আসবেই। কিন্তু, ‘নন-ক্যাননিক্যাল টেক্সট’, ‘পপুলার লিটারেচার’ — সহজ ভাষায় যাদের ‘বিনোদনমূলক লেখা’ বলা যায়, বা আরও তাচ্ছিল্যমূলক পরিভাষায় ‘পাতি লেখা’ বলা যায় — তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো প্রশ্ন উঁকি মারে কি? উত্তরটা হলো, না, দূর দিগন্তরেখাতেও তাদের অস্তিত্ব দেখা যায় না। তার কারণ  দু’টি। প্রথমত, বুর্জোয়া ক্রিটিকরা ‘সাহিত্যের’ সংজ্ঞা ও পরিসীমা নির্ধারণ করার পথে বিভিন্ন তথাকথিত গুণগত মানের উপর নির্ভর করেছেন। তার ফলে এক ‘সম্পূর্ণ বৃত্ত’ অঙ্কিত হয়েছে। এই বৃত্তের কোনো খোলা মুখ নেই যা দিয়ে বৃত্তের বাইরের কোনো লেখা ভিতরে প্রবেশ করে নিজের স্থান করে নেবে। এই বৃত্তরেখার বাইরে যা কিছু তা অচ্ছুৎ, বাতিল, নিম্ন-বর্গীয়, কুৎসিততারা হলো লক্ষ্মণরেখার  বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাবণের মতো। ‘পপুলার লিটারেচার’ মানব জীবনের চিরন্তন সত্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই, এগুলো তথাকথিত নিম্ন-বর্গীয় সাহিত্য, বা একেবারে সাহিত্যই নয়। তাদের জনপ্রিয়তা যতই থাকুক, সাধারণ মানুষের উপরে তাদের যতই সুদূর-বিস্তৃত প্রভাব থাকুক, তারা গুরুগম্ভীর আলোচনা ও সূক্ষ্ম দার্শনিক বিশ্লেষণের অযোগ্য। দ্বিতীয়ত, মার্ক্সীয় ক্রিটিকদের ক্ষেত্রেও — সামান্য কয়েকজন এবং সামান্য কিছু ক্ষেত্র বাদে যেমন গ্রামশি, রেমণ্ড উইলিয়ামস, রোলাঁ বার্ত, উম্বার্তো একো, ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল অফ থট’ ইত্যাদি — ‘সাহিত্য’ উপাধিপ্রাপ্ত লেখার গণ্ডিটি একই থেকে গেছে, শুধু সেই গণ্ডির ভিতরের লেখাগুলির মান যাচাই করার পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। লুকাচ শুধুমাত্র ‘ওয়ার্ল্ড হিস্টোরিকাল লিটারেচার’ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, একটিও শব্দ খরচ করেননি পপুলার লিটারেচার নিয়ে। গোল্ডম্যান বলেছেন ‘ওয়ার্ল্ড-ভিউ অ্যানালাইসিস’-এর পদ্ধতি “valid only for the great works of the past”, এবং শুধুমাত্র ‘the great works of literature’ বিশ্ব-জগতের প্রকৃত ছবি তুলে ধরে। [Goldmann. 314] আর স্ট্রাকচারাল মার্ক্সিস্ট আলথুজার authentic art’ এবং ‘works of an average or mediocre level’-এর তফাৎ করে দ্বিতীয়টিকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন। [Althusser. 204] এঁদের কাছেও ‘পপুলার লিটারেচার’ অচ্ছুৎ, বাতিল হিসেবে থেকে গেছেযদিও এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তোলাই যায় যা হয়তো যথেষ্ট সঙ্গত। স্টুয়ার্ট হল তুলেছেন সেই প্রশ্ন:

“Why is that the text, the many texts, the many signifying practices which are present in any social formation have yielded, as the administered curriculum of literary studies, these ten books up to the top; then these twenty books with a question mark above them; then those fifty books which we know about but which we only need to read very quickly; and then those hundreds and thousands of texts nobody ever reads? That hierarchy itself, which constitutes the selective tradition in literary studies, becomes the first object to be interrogated.” [Hall 26]


যে কোনো র‍্যাডিক্যাল সাহিত্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সাহিত্যের ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইন্টারটেক্সচুয়াল সম্পর্কের গতানুগতিক ও প্রচলিত হায়ারার্কিকাল স্তরের উপস্থিতিকে সবথেকে আগে প্রশ্নের সম্মুখে ফেলা উচিৎ নয় কি? এই নাক উঁচু হেজিমোনিক মানসিকতা ভেঙ্গে দেওয়া উচিৎ নয় কি? প্রশ্ন আসতে পারে মার্ক্সীয় ক্রিটিকরা এই প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি তুলতে সমর্থ হননি কেন? বুর্জোয়া ক্রিটিকদের প্রতি মার্ক্সীয় ক্রিটিকদের বিরোধিতা ও সমালোচনা এবং একই সঙ্গে বুর্জোয়া ক্রিটিকদের হেজিমোনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘পিয়োর’ ও ‘ইম্পিয়োর’ শ্রেণী বিভাজনকে মেনে নেওয়ার মার্ক্সীয় পন্থাকে টোনি বেনেট কিছুটা শ্লেষাত্মক ঢঙে বিবৃত করেছেন:

“Marxist criticism has functioned largely corroboratively in relation to the distinctions forged by bourgeois approving of the same body of canonized works but for different reasons, and disapproving of the rest— lumped together as a residue— but, again, for different reasons. Bourgeois criticism has thus been simultaneously patted on the back for having recognized which works are truly great and taken to task for having misrecognized the reasons for their greatness.” [Bennet]
   
বেনেটের শ্লেষটুকুকে বাদ দিয়ে শুধু বিবৃত ঘটনাগুলোকে ছেঁকে তুলে নেওয়া যাক। বেনেটের কথা থেকেই বোঝা যায় যদিও বুর্জোয়া সৃষ্ট ‘হাই লিটারেচার’ ও ‘লো লিটারেচারের’ শ্রেণী বিভাজনকে মার্ক্সীয়রা মেনে নিয়েছেন, কিন্তু এই মেনে নেওয়ার পিছনে কারণ ও যুক্তি ছিল বুর্জোয়া চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই ভিন্ন কারণ ও যুক্তিগুলি কি? মার্ক্সীয় ক্রিটিকদের মতে ক্লাসিক্যাল মার্ক্সিজমে ‘সাহিত্য, বিজ্ঞান (মার্ক্সিজম) এবং আদর্শ’ মিলে যে “হোলি ট্রিনিটি অফ দ্য সুপারস্ট্রাকচার” গঠিত হয় সেই ‘সুপারস্ট্রাকচার’ অনুযায়ী ‘পপুলার লিটারেচারকে’ মার্ক্সিজম বলা যায় না, কারণ এই ধরনের লেখায় সামাজিক সম্পর্কের কোনো বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।  আবার এই সব লেখা ‘সাহিত্যও’ নয়, কারণ সাহিত্যের সমালোচনামূলক তীক্ষ্ণতা থাকে না এক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে ‘পপুলার লিটারেচার’ হল ‘ইডিওলজি’—

“Popular literature should be regarded as a specific ideological practice within an ideological apparatus (publishing, communications, media, etc.), and as such participates in the permanent insertion of individuals and their actions in practices governed by ideological apparatuses.” [Bromley. 42]

টোনি ব্রোমলে তাঁর উপরে উদ্ধৃত উক্তিটি থেকে আরও একটু এগিয়ে বলেছেন, “[popular literature] is not a primary site of ideology (cf. the educational system) but is one of the secondary areas where ideological components are represented, and reinforced…” [40] ব্রোমলের মতে যে ইডিওলজিকাল ডিসকোর্স রাষ্ট্র বহন ও ব্যক্ত করে তাকে স্বাভাবিক রূপ দান করাই হচ্ছে ‘পপুলার লিটারেচারের’ কাজ। এক্ষেত্রে রোলাঁ বার্ত-এর বিভিন্ন শ্রেণীর ‘মিথ’-এর মতো একই প্রক্রিয়ায় কাজ করে ‘পপুলার লিটারেচার’:

“In naturalizing the order of ideological signifiers contained within it, the popular text does ‘operate’ on ideology, but only by way of passing it on unnoticed, ‘uniform, unambiguous and non-contradictory.” [Bennet]

পপুলার লিটারেচার; নির্দিষ্ট অর্থে ‘স্পাই ফিকশন’; আরও নির্দিষ্ট অর্থে ইয়ান ফ্লেমিং রচিত ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ উপন্যাসটির ক্ষেত্রে এই মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ ভীষণ ভাবেই যথাযথ। এবার, আবার ফেরা যাক কাল্পনিক চতুর্ভুজটিতে। ‘লেখক’, ‘ইতিহাস’, ‘রাষ্ট্র নির্ধারিত ইডিওলজি’ ও ‘চরিত্রের’ স্থানে বসানো যাক ‘ইয়ান ফ্লেমিং’, ‘কোল্ড ওয়ার চলাকালীন ইতিহাসকাল’, ‘সেই সময়কালে ব্রিটেন বা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের রাশিয়া-বিরোধী রাজনৈতিক এবং মার্ক্সিজম-বিরোধী বুর্জোয়া ইডিওলজি’ এবং ‘জেমস বন্ড’। আমরা আরও একবার দৃশ্যের বাইরে থেকে সমগ্র দৃশ্যটিকে দেখব, উপর থেকে খাতায় আঁকা চতুর্ভুজের বাহুগুলির অন্তর্নিহিত সম্পর্কের যথার্থতা বিচার করবো — এই ধারাবাহিক প্রবন্ধে, পরবর্তী ছ’টি পর্বে, আগামী ছ’টি সংখ্যায়


গ্রন্থসূত্র

1) Goldmann, Lucien. The Hidden God: A Study of Tragic Vision in the Pensées of Pascal and the Tragedies of Racine (London: Routledge and Kegan Paul, 1964)
2) Althusser, Luis. ‘A Letter on Art’, in Lenin and Philosophy and Other Essays (London: New   Left Books, 1971)
3) Hall, Stuart. ‘Some Paradigms in Cultural Studies’, Annali, XXI (3) (1978).
4) Bennet, Tony. ‘Marxism and Popular Fiction’. Literature and History. 7, Autumn 1981.

5) Bromley, Roger. ‘Natural Boundaries: the Social Function of Popular Fiction’. Red Letters. No 7 (1978).

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন