কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

দেবযানী কর সিন্‌হা


নীল রঙের লজেন্স

একদিকে অনতিদীর্ঘ নারকেল বন, ন্যদিকে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। জলগর্ভ থেকে   চারটে শরীর আস্তে আস্তে বালুতটে উঠে লো প্রায় ভাসতে ভাসতে উঠে আসল  তারা। এই দুপুরের ঝঞ্ঝাট সৃষ্টিকারী পৃথিবী কি তাদের দেখছে না? দেখছে ঠিককিন্তু দুর্যোগ কখনো বাঁচবার গান গায় না! যখন আসে সম্পূর্ণ মেরে দিয়ে অনির্দিষ্টের  দিকে  নিয়ে যায় মানব জীবনকে। সাঁতরে উঠে আসতেই ধীরে ধীরে ওরা বালির ঠিকানা পেল। ওরা ছুঁলো জনজীবনের কোলাহল। এতক্ষণ তো বধির হয়ে জড়ত্বে  জলগর্ভে আকন্ঠ ডুবে ছিল তারা। কোথায় মা'য়ের আঁচলের টুকরোকোথায় বাবার বলিষ্ঠ হাত? খুঁজে পাচ্ছিল না!

বাবার মাছ নিয়ে আসবার কথা ছিল। কোনোভাবে চরে এসে যেতে জ্ঞান ফেরে ওদের। দেখল, ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। সব গ্রাস করে নিয়েছে সমুদ্র। ভাঙাচোরা ঘরগুলো দেখে সব অবাক লো না। এমন ঘটনা কতবার ঘটেছে, কতবার ধ্বসে গেছে এই জলকেন্দ্রিক জীবন যাত্রা আবার একটু একটু করে তৈরি হয়েছে সেই ঘর।  মা তার তিন সন্তান একে একে এসে  প্রথমে মিলিত হলো খানিকটা সময় সমুদ্রের  দিকে চেয়ে থাকল। অপেক্ষা! কার ন্য  শিয়রে শমন কালে অপেক্ষা! খুব কাছের  মানুষের ন্য অপেক্ষাও যেন ন্যাসমুদ্র ফিরিয়ে দেয়, নেয় না কিছুই। এই মুহূর্তে ওদের কাছে পৃথিবী যেন একটা ভ্রাম্যমান জলযান। বালিতে দাঁড়িয়েও সর সর করে সরে যাচ্ছে পা। নারকেল বন গলা পর্যন্ত ঢেকে আছে। এইসব দেখে শিশুরা আনন্দে লাফিয়ে উঠছে। বড় ছেলেটা সামলাতে চেষ্টা করল বাকি তিন জনকে। মা অসহায়।  সে দৌড়তে পারবে না।শক্ত করে ধরে আছে সন্তানদের হাত। বিপদ সীমার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। অথচ সাবধানতা কী জিনিস, জানে না!

আচমকা চারিদিকে ঘোষণা শুনে ওরা জল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে দূরে চলে যেতে বাধ‌্য হয়। বাবার আশা ছেড়ে উঠে এলো ওরা। প্রিয়কে হারানোর জন‌্য এমন কান্নার সুর সমস্ত এলাকায় জুড়ে। কে কাকে জানাবে? ওদেরই মতো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল। শুনল, আরো দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে ওদের। সার বেঁধে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গা আর নিজেদের এক্তিয়ারে নেই। সরকার থাকবার জন‌্য ভালো জায়গায় ঘর দিচ্ছে। ওদের মতো প্রাণ হাতের মুঠোয় করে বহু  লোক শহরের নানা জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। এখানে জলবসতির চিহ্ন মাত্র থাকবে না আর। দিনদিন বেড়েই চলেছে জলোচ্ছ্বাস। আপন জায়গা বলতে কিছু থাকল না!  চেন্নাইয়ের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলো বেশিরভাগ এখন জলমগ্ন। হোটেল, রেস্তরাঁ, হস্টেল সব বিধ্বস্ত
মা তার চার সন্তানকে নিয়ে বড় বিপাকে পড়েছে। ভারি পেট নিয়ে সেও ছুটতে পারছে না। কিছুটা হেঁটে যেতে পারলে শরণার্থীদের ক‌্যাম্প। ওখানে গেলেই খাবার মিলবে একথা শুনেই ধুম পড়ে গেল যাওয়ার। সকলের সঙ্গে বালির পর্বত ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। সবাই গাড়ির জন‌্য আর দাঁড়াতে চাইছে  না। পারলে দৌড়ে যাবে।বলাবলি করছে, ওখানে খাওয়ার ভাবনা নেই, মাথা গোঁজার জায়গাও নাকি পাবে। আর ভাবনা কী! ছেলেমেয়েগুলো মা কে ছেড়ে গাড়িতে উঠল না। ওরা একজন যেন চারজনের সমষ্টি। যতই কষ্ট হোক, এতটা পথ হেঁটেই এলো মায়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে। এরপর যখন বিকেল হবে হবে, ঠিক সেই সময় আরো  অনেক মানুষের পেছন পেছন ওরাও একটা উঁচু মতো জায়গায় কাপড় দিয়ে বানানো অসংখ‌্য ঘরের সামনে এসে বড় বড় শ্বাস ফেলল। প্রাণের আরাম মিলেছে। এ রাজ‌্যে  এত মানুষের কোলাহলেও সমুদ্রের প্রাণ টলে না, তবু সুখের লোভ স্বজন হারানোকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। মানুষ কী চায়? আবদুল এইসব ভাবছে বসে বসে। ছোট দুটো ঘুম চোখে লুটিয়ে পড়েছে। মাকে ঘিরে  গুটলি মেরে ভিজে গায়েই শুয়ে পড়েছে ওরা। মায়ের ঢাকের মতো পেট ওঠানামা করছে। ক্লান্ত, কালশিটে ছায়া পড়েছে সারা মুখে। আবদুল জানে, আর কিছুদিনের মধ‌্যে আরো একটা ভাই বা বোন আসবে তার।

কী ভেবে মাথাটা ঘুরে গেল, ওর মনে হলো এক্ষুনি বাবাকে খুঁজে আনতে হবে। যে  করে হোক! বাবাকে মায়ের খুব দরকার। দুর্যোগে হারিয়ে গেলে প্রাণ নিয়ে কেউ ফেরে না, একথা মা অনেকবার বলেছে। তারা ফিরল কেমন করে? এত প্রশ্ন করবার  সময় ছিল না তখন। এখন সুস্হ লাগছে মা আর ভাইবোনদের। এতেই যেন বাবার  অভাববোধটা তাকে অস্হির করে দিচ্ছে বেশি করে। আবদুলের বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ওদের বাবা আর কখনো ফিরবেই না! ওর চোখে ঘুম নেই। এখানে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। ভেতরে আস্ত একটা সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে। একটানা হুইসেল বাজছে বুকের ভেতর। চোদ্দ বছর বয়েস ওর। মাত্র চোদ্দ। মন দিয়ে সে মাকে  দেখল কিছুক্ষ মায়াভরা চোখে, ভাইবোনকে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এই জায়গাটা সমুদ্রতট থেকে অনেকটাই দূরে। পায়ে বালি লাগছে না। শুকনো মাটি। নানান প্রজাতির গাছপালা। চোখে বালি ঢুকে কড়কড় করে উঠছে না চোখদুটো। তবুও সেটাই ছিল  ভালো। বাবা ছিল। বাবা নেই কোথাও। সমুদ্র নাকি যা নেয় ফিরিয়ে দেয়, তাহলে বাবা গেল কোথায়? গভীর রাতে মাকে এড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসল সে। তারপর দৌড়ল শমনের মতো।  










https://ssl.gstatic.com/ui/v1/icons/mail/images/cleardot.gif




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন