কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

ইশরাত তানিয়া

একটি ঘুম কিংবা জেগে ওঠার গল্প

আমি ভুল মেটাফোর’, নীলাভ বলেছিল, ‘ভুলে যা, আর অনেক অনেক আলো আঁকিস।   
তীর্ণা ভাবে অবিশ্বাসী বাঁচা বড় কষ্টের। ঈশ্বর! আলোয়-আঁধারে আর কবে ও মানুষ চিনবে?  
জেগে থাকার কথা থাকলেও রাতে তীর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছিল। বারোটা বাজার কিছু আগে  পরে। যে রোজ জাগে, কথা বলুক আর না বলুক, তাকে কথা আছে, থেকোবলা সত্ত্বেও ঘুমিয়ে গেল। হয়েছিল এমনই কারণ যা হবার নয় তাই হয়। অন্তত তীর্ণার ক্ষেত্রে। সকালে উঠে ভেবেছে, দাঁত ব্রাশ করতে করতে, রাতে কেন সে ঘুমিয়ে পড়ল? ব্রেডে পিনাট বাটার মাখাতে মাখাতে মনে হয়েছে, মাঝরাতে আবার অমন হঠাৎ ঘুম ভাঙলো?
       
স্পা করা সুগন্ধী চুল হাওয়ায় তুমুল উড়ছে। শীতের আনন্দে ধুলোবালি তখনও পিন ফুটিয়ে দেয়নি। রিকশায় চারুকলা যেতে যেতে তীর্ণা ভেবেছে, ভাগ্যিস ভেঙেছিল! সেই কালঘুম আর কী। ঠিক রাত দুটোর সময়। নইলে নীলাভ ধরেই নিত না-হওয়া ভালোবাসাবাসির গল্প শেষ। সকাল বেলা তীর্ণা জেগে দেখত হাট ভেঙে গেছে। সব ফাঁকা। মধ্যরাতেই যে কেন রায়ট লাগে! ধ্বংসাত্মক উন্মত্ততায় ঘরের চালে আগুন কিংবা অবিরাম মসজিদ মন্দির ভাঙা। আপাতভাবে, কেউ হেরেছে কেউ জিতেছে মনে হলেও আজীবন দীর্ঘমেয়াদে হেরেছে আসলে দু’পক্ষই। রাতে ঘুম ভাঙার কিছু সময় পর  সে বোঝে, একজন বসে আছে অপেক্ষায়। নীলাভর কী বলার ছিল তীর্ণা সেটি জানত  না।
                 
শুয়েছিল সে অন্ধকারে, হাতে ফোন। ভার্চুয়াল এ পাড়া সে পাড়া ঘোরাফেরা। নীলাভর আসার নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট পেরিয়ে আরও প্রায় ত্রিশটি মিনিট মহাকালে মিশে গেল। 
তীর্ণা যত বলে - হলো? 
নীলাভ বলে - হুঁ। 
- হুঁ মানে কী? 
- অনেক কিছুই।  
- উঁহু। কী বলবে?
- যা ইচ্ছে বলব। 

নীলাভ এসে অবাক। ফোন অন। কল রিসিভড্‌ হচ্ছে না। এতক্ষণ যে মেয়ে জানতে চাইছিল বার বার - কী বলবে? সত্যি-সত্যি টেনশান হচ্ছে।সে মেয়েটা কই? নেই তো! নীলাভ চেনে তীর্ণাকে, বুঝে গেছে ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার এ রকমও ভাবছে- এড়িয়ে গেল? ওদিকে ঘুমের ভেতর তীর্ণার কী অস্বস্তি! কী যেন ঠিক  হয়নি। কে  যেন অপেক্ষায়। কোথায় যেন যাবার কথা। প্রবল জলতেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায় ওর। ছি ছি, এটা কেমন হলো! কী করে তীর্ণা ঘুমিয়ে পড়ল? চন্দনের বনে বিপ্রলব্ধ ছটফট করছে। কী কথা বলবে কে জানে, ভালোবাসার কিংবা মন্দবাসার। এদিকে তীর্ণা কী ভীষণ নিদ্রামগ্ন। নীলাভ টেক্সট পাঠিয়েছে - থাকতে বললাম, কই তুই?’ যেন শুনতে পেল তীর্ণা, খুব গভীর ইঁদারা থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা গম্ভীর কন্ঠস্বর। রাতের বাতাস কাঁপছে অন্ধকারে। কাঁপছে তীর্ণাও। কী প্রচণ্ড রাগ আর অভিমান করে জেগে আছে নীলাভ!
   
নীলাভ সে রাতে বলতে চেয়েছিল ভালোবাসার কথা। হয়তো বা তীর্ণার রিমলেস চশমা খুলে কপালে ঠোঁট আঁকতে চেয়েছিল। দুটো ভ্রুর মাঝখানে। তীর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছিল। নীলাভ বলতে পারত - এ্যাই মেয়ে, তুই এত অদ্ভুত কেন? দিনে তিন বার ফোন করিস আবার ঘুমিয়েও পড়িস। তোর কাজের কোনো মাথামুন্ডু নাই!অথচ ফেরারী সময় ফেরে না। না-হওয়াগুলো দীর্ঘশ্বাস রেখে যায় কফি ওয়ার্ল্ডে, নবারুণের হারবার্টে, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তীর্ণার হাতে ফোন। তখনো সে পানি খায়নি। স্ক্রিনের আলোয় সদ্য খোলা চোখ কটকট করে। তুই তোর মতো থাক। ঘুমিয়ে। মিথ্যে ভালোবাসা। নইলে কী করে বারবার...

লেখাগুলো পড়তে পড়তে ঝাপসা চোখের ঘুম বালিশ গড়িয়ে নেমে যায়। কী করে যে কী হলো! ঠিকঠাক ঠাহর করতে গিয়ে পানি খাওয়ার কথা ভুলে যায় তীর্ণা। শূন্যে হাতড়ে তিনটি শব্দ পেয়ে লিখে পাঠাল - আমি খুব সরি। নিজের চোখেই বেমানান লাগছে তিনটি শব্দ। সরিকি শুধু ঘুমিয়ে পড়ার জন্য? একান্তেও সে ঠোঁটে চুমু রাখতে পারেনি। ফিরে এসেছিল জড়িয়ে না ধরেই। কেন এত অপারগতা? ঈশ্বর! আলোয়-আঁধারে আর কবে ও মানুষ চিনবে? শুদ্ধ আর কোমল সুর কেটে যায় এভাবেই। চুলের গন্ধে ডুবে কেউ বলতে চেয়েছিল পিয়ানোর সাদা কালো রিডের অজানা গল্প। জেগে থাকবে কথা দিয়েও তীর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছিল। জেগেও উঠেছিল। আর হ্যাঁ, ভালোও বেসেছিল। নীলাভ আসে না। জল অথবা আগুন থেকে তীর্ণা জেনেছে কেউ জেগে থাকে, না এলেও। যা ছিল বলার অথবা শোনার, ফিরে আসে না কিছুই। শুধু একক আঁধারে তীর্ণার মুহূর্তগুলো তলিয়ে যায়।

টেবিলঘড়ি, হাতঘড়ির চুপচাপ কাঁটাগুলো এলোমেলো ঘুরপাক খায় বারোটা, একটা, দুটো... সেকেন্ড মিনিট ঘণ্টা... কোথায় যে পৌঁছতে হয় বুঝে পায় না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই ধোঁয়াটে নীলাভ ছায়ার ধূ ধূ বিভ্রম, কোথাও আর কিচ্ছুটি নেই।


2 কমেন্টস্: