কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

অলোকপর্ণা

ধারাবাহিক উপন্যাস



তাহার নামটি




(ছয়)

গাড়ির মধ্যে কিছু মানুষ বসে। অন্ধকারে তাদের একজনেরই চোখে আলো এসে পড়ছে। তারা সবাই রাস্তার দিকে তাকানো, যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অঞ্জন গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সবাই সতর্ক হয়ে ওঠে। রাস্তায় তাকাতে অঞ্জন দেখে মহাদেব হেঁটে চলে যাচ্ছেন, নীল গা, বাঘছাল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সহ। মহাদেব কিছুদূর চলে যাওয়ার পর একই দিক থেকে হঠাৎ দৌড়ে আসতে থাকেন মা কালী। তাঁর মুখে কোনো ত্রাস নেই, অতি শান্তভাবে দৌড়ে আসছেন তিনি, রাস্তায় শুধু তাঁর পায়ের আওয়াজ শোনা যায়, ঝম ঝম ঝম ঝম... কালো কুচকুচে আদুর গা, গলায় নরমুণ্ড। কাছে আসতে প্রবল দুলে ওঠে তাঁর বুক।
চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে অঞ্জন ছাদে চলে আসে। পাশেই রাজীবদের বাড়ি, সম্পূর্ণ অন্ধকার। রাজীবের দিদি কী করছে এখন? ঘুমোচ্ছে, না সাপ হয়ে গেছে আবার?  

কালো জিরে তেলে ছেড়ে দিয়ে কাবেরী এসে বসলেন টুলে। উবু হয়ে জলে রেখে দেওয়া ইলিশ মাছের টুকরোগুলোকে তুলে আনলেন। মাছের চোখের মতো নিপাট গোল পৃথিবীতে আর কিছু নেই। গোল ও অনুভূতিহীন। মাছেদের হয় অবাক নয় অনুভূতিশূন্য এই দুই মনোভাব রাখতে দেখেছেন তিনি। আজকের ইলিশ মাছটা অনুভূতিহীন মুখ করে কড়াইয়ের কাছে চলে এল। একটা একটা করে মাছের টুকরো কড়াইয়ে ঢেলে দিলেন কাবেরী। ইলিশ মাছ তেলে সাঁতরাতে লাগল। কাবেরীর হাতের খুন্তিটা যেন নৌকোর দাঁড়। মাছকে তেলে ঢেলে কাবেরী নিজেও লাফ দিলেন কড়াইয়ের ভেতর। খুন্তি নেড়ে চললেন, তেলে ঘূর্ণি উঠতে লাগল। প্রবল ঘুর্ণি একসময় ঝড়ের আকার নিলে কাবেরী হেসে উঠলেন। এক কড়াই তেলে মাছের টুকরোদের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে কাবেরী হাসতে লাগলেন।

কচকচ গাজর খাচ্ছিল পিম। খাঁচার মধ্যে আঙুল বাড়িয়ে দিতেই কক করে কামড়ে ধরল সে।... পিম ছাড়ো! রঞ্জনার চোখ রাঙ্গানি পাত্তা না দিয়ে কক কক করে তর্জনীটা গিলে ফেলল পিম। আর গিলে ফেলতেই তার গোঁফগুলো ফুলে ফুলে উঠল। পেশী উঠল মোটা হয়ে। খাঁচার ভিতরেই পিম নিজের দ্বিগুণ হয়ে উঠতে লাগল রঞ্জনার তর্জনী গিলে ফেলে।... পিম! এ কী অবস্থা তোর! খাঁচা ফাটিয়ে পিম মেঝেতে এসে নামল, গোলাপি নাক অল্প অল্প নাচাতে নাচাতে টকটকে লাল চোখে রঞ্জনার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল।

মা আবার ঘুমের মধ্যে হাসছে, বিরক্ত হয়ে রাজীব পাশ ফিরতেই দেখতে পায়, নিজের ঘর থেকে দৌড়ে তাদের ঘরে এসে পড়ল রঞ্জনা। চটপট খিল লাগিয়ে দিল দরজায়, তারপর মশারি উঠিয়ে মায়ের পায়ের কাছে দলা পাকিয়ে শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে এদের কী যে হয়! রাজীব আবার পাশ ফিরে শোয়।

“কাবেরী, কাবেরী!”
“হ্যাঁ দাদা বলুন”, মাছগুলোকে তেলে ছেড়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ান কাবেরী।
“ঋতমের মা কি ফোন করেচিলেন?”
“না তো... আমি ভাবলাম আপনাকে করেচেন নিশ্চয়...”
“না না, আমায় করেননি, কী হলো বলতো...?”
“দেকুন, এই তো পরশু দেকে গেচে, আর দুই দিন দেকুন, না করলে...”
“না করলে?”
“না করলে আর কি, আমার মাচগুনো পুরচে দাদা...” রান্নাঘরে ছুটলেন কাবেরী।
“একবার জিজিকে দেকা করতে বোলো তো, সে নিশ্চয়ই কিচু বলেচে ঋতমকে”
“আচ্চা”
সুনীল মজুমদার চলে যান। আঁচ কমিয়ে কাবেরী ঘরে আসেন। রঞ্জনা তখনও গোল পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
“অ্যাই মেয়ে, ওঠ!” রঞ্জনার থাইতে চাপড় মারেন কাবেরী। কোনো সাড়া পাওয়া যায় না তার থেকে।
“জিজি!”
উঃ!”
“ওঠ, যা দ্যাখ নটা বেজে গেল!”
“নটা!” ধড়মড় করে উঠে বসে রঞ্জনা, “তুমি ডাকোনি আমায়!” এক লাফে ব্রাশ করতে ছুটল সে।
“না খেয়ে যদি যাস, দেকিস কি করি!”
“সময় নেই”- দু মিনিটে তাকে তৈরি হয়ে নীচে নামতে দেখা গেল।
“জিজি, পিমকে পাতাকটা দিয়ে যা!”
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে থমকে দাঁড়ায় রঞ্জনা, পিম... ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় ও?”
“ছাতে, ঘুরচে...”
“আমি চললাম”, কোনোক্রমে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যায় রঞ্জনা।
“চললাম মানে! দিয়ে যা পাতাগুনো!” ঝনঝন করে সাইকেল বের করার আওয়াজ পান কাবেরী। এই মেয়ের জন্য তাঁর শান্তি হলো না!



স্টেশানের সিঁড়ি দিয়ে ঋতমকে উপরে উঠতে দেখে সাইকেল ফেলে রঞ্জনা ছুটে আসে তার কাছে।
“এই নে...” হাঁফাতে হাঁফাতে তার হাতে অনেকগুলো কাগজ গুঁজে দেয়।
“কি আছে এতে?”
“পড়িস... তোর ট্রেন এসে গেল”
কাগজগুলো হাতে নিয়ে দৌড় লাগায় ঋতম প্ল্যাটফর্মের দিকে। রঞ্জনা ফিরে এসে সাইকেল দাঁড় করায়। সাড়ে নটা থেকে আবৃত্তি ক্লাস।

“দুড়্‌ দুড়্‌ ছুটে যাই, দূর থেকে দেখি
প্রাণপণে ঠোঁট চাটে কানকাটা নেকী!
গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা,
ধুক ক’রে নিভে গেল বুকভরা আশা।”

বিড়ালের মতো পিঠ ফুলিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে এক পাক হেঁটে নেয় রঞ্জনা।  বাচ্চাগুলোর কী আনন্দ তাই দেখে! “এদিকেও এসো, এদিকেও এসো,” বলে তারা  ডেকে ডেকে নিয়ে যায় রঞ্জনাকে। আর বিড়ালের মতো পিঠ ফুলিয়ে রঞ্জনা তাদের  দলে মিশে যায়। ক্লাস শেষ হলে যে যার বাবা মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরে। রিচা বসে আছে শতরঞ্চির এক কোণে।
“কি রে, কেউ এল না?”
“না মিস”
“কে আসবে?”
“বাবা”
“বাড়ি কোথায়?”
“সানসাইন ইস্কুলের পাশে”
“সানসাইন ইস্কুলের পাশে কোনখানে?”
“ওই যে কাঁঠাল গাছ আছে, আমাদের বাড়ি”
“কাঁঠাল গাছ... ঠিকানা জানিস না?”
“না”
“তাহলে বসে থাক, বাবা আসুক, নিয়ে যাবে।”
“বাবা না এলে?”
“আসবেই”
“যদি না আসে?”
“আসে না এমন হয় না”
“তাই?”
“হুম তাই” রঞ্জনা বসে পড়ে রিচার পাশে।

তখনই একটা সাইকেলের বেল শোনা যায়, “বাবা এসেছে” বলে রিচা দৌড়ে চলে যায়। রঞ্জনা তার পিছু পিছু দরজায় আসে। রিচা সাইকেলে উঠে “বাই মিস” বলে চলে যেতেই একটা রিক্সা এসে দাঁড়ায় আবৃত্তি ক্লাসের সামনে। একজন মানুষ রিক্সা থেকে নেমে রঞ্জনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকেন, “জিজি, এসো, বাড়ি যাবে না?” রঞ্জনা রিক্সায় উঠে পড়লে শীতের সকালে রিক্সা শনশন করে এগিয়ে চলে।

অনিল বাবুর ক্লাস থেকে অঞ্জন মেয়েটার পিছু নিয়েছে। সাইকেল হাঁটিয়ে বেশ ব্যবধান রেখেই সে মেয়েটার পাড়ায় ঢুকে এসেছে। মেয়েটা নিজের বাড়িতে ঢুকে গেলে অঞ্জন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে এবারে কি করা যেতে পারে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা আবার বেরিয়ে আসে, অঞ্জন তাকে দেখে একটু সজাগ হয়। মেয়েটা খুব দ্রুত এগিয়ে আসে অঞ্জনের দিকেই, সাইকেলে উঠে পালাবে কি না ভেবে ওঠার আগেই মেয়েটা তার সামনে এসে পড়ে, “ভিতরে আয়”, মেয়েটার পিছু পিছু বাধ্য ছাত্রের মতো অঞ্জন মেয়েটার বাড়িতে ঢোকে।  
আবার সেই দোতলার ঘর। সুসজ্জিত সোফা। ফ্যামিলি ফটো। অঞ্জনকে বসতে বলে মেয়েটা কোথায় চলে যায় কিছু পরে হাতে করে ফটোকপি করা টি. পি. মাইতি  নিয়ে ঢোকে, “এই নে...”
“এইটা...?”
“এটা নিতেই তো এসেছিস?”
“না”
“তবে?”
“সেদিন...”
“সেদিন কি? সেদিন কিছুই হয়নি।”
“সরি”
“তুই যে কাউকে কিছু বলিসনি সেটাই অনেক, রাজীব টাজিব হলে আমার বুকের শেপ অবধি শুনিয়ে দিত সবাইকে... রাজীব হলে অবশ্য, চান্স ছাড়ত না। যাক গে, কিছু খাবি?”
“জল?”
“দাঁড়া”, মেয়েটা আবার অন্য ঘরে চলে যায়।
টি টেবিলে মোটা বায়োলজি খাতা রাখা, জেরক্স করার সময় অঞ্জন খেয়াল করেনি, এখন দেখতে পেল তার এককোণে নাম লেখা আছে, নামটা পড়তে যাওয়ার আগেই গ্লাস হাতে মেয়েটা ঢোকে।
“এই নে...”
এক চুমুকে পুরো জলটা খেয়ে ফেলে অঞ্জন। “কিছু মনে করিস না, তোর নাম...?”
“গরিমা”
“সুন্দর নাম”
“তুই কি নাম জানতে ফিরে এসেছিস?”
“না না”
“তাহলে?” ভ্রূ কুঁচকে গরিমা অঞ্জনকে দেখে কিছুক্ষণ, অঞ্জন গরিমার চোখে চোখ রাখতে পারে না। “চল...” এক হাতে খপ করে অঞ্জনের হাত ধরে তাকে টানতে টানতে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে গরিমা ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।


(ক্রমশ) 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন