কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

শ্যামশ্রী চাকী

অবয়ব


মা, প্লিজ ওই রেসলিং কারটা! প্লিজ মা ডিসকাউন্ট দিচ্ছে...
এই অফারটা আর পাবে না!  হাত শক্ত করে ধরে হনহন করে হেঁটে যায় সুনীতা...  আর একটাও বায়না নয়! রোজ রোজ নতুন খেলনা লাগে, না তোর?  
আকাশের চোখ মুহূর্তে ছলছল, কই মাসবার তো কত খেলনা, আর্য, রাজ  ওদের তো ফান ওয়ার্ল্ডের সব মডেলগুলো আছে। আমার মাত্র একটা!
উত্তর না দিয়ে এস্কেলেটর চেপে গ্রসারি ডিপার্টমেন্টের দিকে এগোয় সুনীতা। নাছোড়  আকাশ তখনো বকেই চলেছে, মা জানো? নতুন বেবলেট লঞ্চ করেছে! ফাইটিং এলড্র‍্যাগো... এ্যাটাক মোডে! মা আমি এবারে সবকটা ওয়ার্কশীটে ফুল মার্ক্স পেলে কিনে দেবেআমি পিগি ব্যাংক ভেঙে একটা বেবলেট স্টেডিয়াম কিনব, তুমি কিন্তু না বলবে না!

আকাশ আপন মনেই বকবক করে, সুনীতা ট্রলি টেনে নিয়ে হাঁটে লিস্ট মিলিয়ে  জিনিস তোলে চাল, ডাল, মাখন, চীজ।
 মশলার সেকশনটা ডানপাশে। সব গুছিয়ে তুলে ধীরেসুস্থে ওদিকে যায় সুনীতা। বাইরের তুমুল ঝড় বৃষ্টি, ফাঁকা শপিংমলের ওপ্রান্তের আলোগুলো ঝাপসা, কেমন ভয় ভয় লাগে সুনীতার। আকাশকে কাছে টেনে নেয়।

বাইরে কোথাও কড়কড় শব্দে বাজ পরে। কাচের উইন্ডো গ্লাস জুড়ে জলের ছিটে। কটা সবুজ আপেল আর স্ট্রবেরীর প্যাকেট তুলে নেয় সুনীতা। আকাশ এ্যাপেল  মাফিন খুব ভালোবাসে, কাল টিফিনে বানিয়ে দেবে আর স্ট্রবেরীটা স্পেশালি আকাশের বাবার জন্য, দেড় বছর বাদে কাল দেশে ফিরছে রূপক স্ট্রবেরী আর  প্লাম মিলিয়ে সেই ডেজার্টটা বানিয়ে সারপ্রাইজ দেবে রূপককে। কাউন্টারের সামনে বিল চুকাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করে আকাশ নেইবুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে সুনীতার! এদিক ওদিক দৌড়ে ফেরে উদভ্রান্তের মত কপালে ঘাম জমে এই  ঠান্ডায় খেলনার র‍্যাকগুলো থেকে কতগুলো ক্ষুদে গাড়ি হাতে নিয়ে একমনে দেখছে আকাশ, খেলছে আপন মনেই। সামনে গিয়ে ঝাঁকুনি দিতেই বড় বড় চোখ মেলে তাকায় আকাশ, এগুলো হট হুইল কার, জানো মা? ঠান্ডা জলে ডোবালে কালার  চেঞ্জ করে। একটা নিই মা? প্লিইইইইজ!

কোনমতে মাথা ঝাঁকায় সুনীতা। আকাশকে নিয়ে বেসমেন্টে নেমে আসে। ফাঁকা  গেইম জোনে একমনে বাইক রেসিং খেলে যাচ্ছে আকাশভিডিও স্ক্রিনে ছুটে চলছে বাইক, সেগুলো হাতের ছোট্ট যন্ত্রে কন্টোল করছে ছোট্ট ছেলেটা দক্ষ পরিচালনা ওই নরম  হাতের মুঠোয়। বুকটা মুচড়ে ওঠে সুনীতার।  

মুখে আইসক্রিমের দাগ লেগে, কাছে এসে রুমালে মুখ মুছিয়ে দেয়, আকাশের দৃষ্টি  ওই স্ক্রিনে স্থির। দু’ পা পিছিয়ে আসে সুনীতা। মেঝের ওই ফাটলের দিকে তাকায়, টলোমলো অশ্রুবিন্দুতে গোটা শপিংমল একটা বুদবুদ।  আকাশের হাতটা চেপে ধরে সুনীতা। গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় দুটি অবয়ব।

ঘড়িতে তখন ভোর চারটে।

তিন বছর আগে সুনীতা এসেছিল আকাশকে নিয়ে এই শপিংমলে মুভি দেখে  আইসক্রিম খেয়ে কেনাকাটা চলছিল মা ছেলের। রূপকের ফ্লাইট তখন মধ্যগগনে। বাড়ি ফেরা হয়নি ওদের। গেম জোনে উগ্রপন্থীদের রাখা বোম ব্লাস্টে প্রাণ  হারিয়েছিল শতাধিক মানুষ সুনীতা আকাশের নাম ছিল মৃত তালিকার দ্বিতীয় সারিতে। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া লাশ দুটির হাত ধরা ছিল শক্ত করে। ছোট্ট মুঠিতে হট হুইল কার। বিয়ের আংটিটা দেখে শনাক্ত করেছিল রূপক। নাহ! রূপকও আর ঘরে  ফেরেনি, ওর খবর কেউ রাখে না । আসলে খবর রাখবার লোকেরা নিজেরাই তখন খবরের হেড লাইনে।


এক বছর হল শপিং মল আবার খুলেছে নতুন রূপে ঢেলে সেজেছে ঝাঁ চকচকে মল। রোজ রাতে সেই শপিং মলে আকাশের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় সুনীতা। হাসে  গল্প করে মা আর ছেলে, নতুন নতুন জিনিসপত্র নড়াচাড়া করে, ট্রলিতে তোলে, আবার ভোরের আলো ফুটলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।  দূরে  দাঁড়িয়ে থাকে রূপক ওই শপিংমলের বাইরে। সেদিন রাতেই সবার অজান্তে নদীতে  নেমে জলের গভীরে সমস্ত শোক তাপ বিলিয়ে দিয়েছিল রূপক। রূপক জানে সুনীতা একদিন আকাশকে নিয়ে শপিংমল থেকে বেরিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াবেই। তাই রাতভোর অপেক্ষায় আজও রূপক। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন