কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

শিবাংশু দে

বৃষ্টিহাওয়া, ব্রহ্মপুত্র খেয়াঘাট




‘তখনো ছিলো অন্ধকার    তখনও ছিলো বেলা
হৃদয়পুরে জটিলতার    চলিতেছিলো খেলা
ডুবিয়াছিলো নদীর ধার   আকাশে অধোলীন
সুষমাময়ী চন্দ্রমার   নয়ান ক্ষমাহীন...

(হৃদয়পুরঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

নদী নদের পার্থক্য বেশ জটিল ব্যাপার অন্তত যখন ইশকুলে ভূগোল পড়তুম, তখন তো তাই মনে হতো নাম মুখস্ত করতে গেলে দুটি নদের নামই মনে থাকতো সিন্ধু আর ব্রহ্মপুত্র বাকিরা নদী নদীকে নিয়ে মানুষের রুমানি আবেগের শেষ নেই নদী মানে সভ্যতা, নদী মানে পূর্ণতা, নদী মানে গতি শেষ পর্যন্ত নদী মানে নারী তার আর পর নেই নদ খুঁজতে গেলে লদাখে সিন্ধু'কে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু এদেশের সীমার মধ্যে তার সেই শানশওকত নেই সে কথা বলা যায় না বুড়া লুই'কে নিয়ে বুড়া লুই মানে লোহিত মানে ব্রহ্মপুত্র তার কোনও জুড়ি নেই সারা বছরই তার কাছে যাওয়া যায় কিন্তু বর্ষাকালে তার রোয়াব মাশাল্লাহ অনেকদিন ধরেই ভাবি একটা সন্ধে বুড়া লুইয়ের কোলে কাটাই এমন একটা অপরাহ্ন ইচ্ছে হয়েই ছিলো মনের মাঝে বর্ষাবিভোর ব্রহ্মপুত্রে একদিন  ভাসতে ভাসতে মেঘের ভিতর ডুবে যাওয়া দিনের বাড়ি যাওয়া দেখবো মন থেকে চোখের সামনে সে আর আসেনি কখনও এতদিন

সেই কোন দক্ষিণ পশ্চিম তিব্বতে আছে এক তালুং সো হ্রদ, আছে আঙ্গসি হিমবাহ সেখান থেকে বয়ে এলো ইয়ারলুং সাংপো নদী অরুণাচলে ঢুকবার পর তার নাম প্রথমে হলো সিয়াং তার পর ডিহাং অসমে নেমে আসতে আসতে মিলে গেলো দিবাং আর লোহিত নদীর সঙ্গে, সোনিতপুরে তার নাম হলো কামেং আর সেই দারুণ রোম্যান্টিক নাম, জিয়া ভরেলি ডিব্রুগড় থেকে দুভাগ হয়ে একশো কিমি দূরে লখিমপুরে আবার মিলে যাচ্ছে দুটি ধারা, মাঝখানে বৃহত্তম নদীদ্বীপ, মাজুলি দু’হাজার ন’শো কিমি  যাত্রা তার সমুদ্রের দিকে বাংলাদেশে  সে যমুনা, মেঘনা চাঁদপুরে তার মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পদ্মা তার বিশাল বিস্তার এই উপমহাদেশের যে কোনও নদীর গৌরব ম্লান করে দেয় অবলীলায় হ্যাঁ, সে তো নদী নয়, সে নদ, এক অদ্বিতীয়, সৃষ্টিকর্তা  ব্রহ্মার ঔরসজাত  ব্রহ্মপুত্র

ফ্যান্সিবাজার উজানবাজার ঘাট থেকে নদীবিহার করার জন্য নানা রকম নৌকো পাওয়া যায় ছোট বড় ডিঙি নৌকো থেকে বড় বিলাসবহুল ফেরিলঞ্চ মাঝখানে  ময়ূর নদীদ্বীপে ভষ্মাচল পাহাড়চূড়ায় ১৬৯৪ সালে তৈরি উমানন্দ শিব মন্দির ভক্তদের সমারোহে মুখর থাকে কালিকাপুরাণে এই শিবের উল্লেখ রয়েছে এই শিবের মাহাত্ম্য কামাখ্যা শক্তিসংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে এই দ্বীপে যাবার জন্য ছোট নৌকো চলে বর্ষার নদীতে তাকে মোচার খোলা ছাড়া কিছু বোধ হয় না  নদীর দুই পারে ছোট বড় নানা পাহাড়, নীলাচল, ফাটাসিল, ইটাখুলি, খারঘুলি, চিত্রাচল, নরকাসুর মাঝখানে বিপুল জলধার নিয়ে বয়ে চলেছে পূর্ববাহিনী ব্রহ্মপুত্র

...ওপারেতে সোনারকূলে আঁধারমূলে কোন মায়া
গেয়ে গেলো কাজ ভোলানো গান...
ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিন শেষের শেষ খেয়ায়...

সকাল থেকেই ঠিক করেছিলুম আজ বিকেলের শেষ খেয়ায় নদীযাত্রা করবো কাজভোলানো সুর ঘুরে বেড়াচ্ছিলো মাথার ভিতর, সকাল থেকে ওখানে আমার সহকর্মীদের বলতে তারা জানালো আল ফ্রেস্কো নামের একটি বেসরকারি ফেরিলঞ্চ বিকেলবেলা নদীভ্রমণের আয়োজন করে অতএব আমরা  শহরের কালাপাহাড় পাড়ার অফিস থেকে বেলাবেলি বেরিয়ে যাত্রা করলুম ফ্যান্সিবাজারের পথে বর্ষা ঋতুর গুয়াহাটির আকাশ, ক্ষণে রুদ্র, ক্ষণে রোরুদ্য, দমকা হাওয়া, ভিজে আবেশ, জুড়িয়ে দেওয়া সবুজ জাহাজঘাটায় পৌঁছে আর গাড়ি থেকে নেমে জেটি পর্যন্ত যেতে পারি না তুমুল বৃষ্টি হঠাৎ দেখি বিশাল ছাতা নিয়ে লঞ্চের কর্মচারীরা এগিয়ে নিতে আসছেন ছাতার আড়াল নিয়ে আধোভিজে নৌকোয় পৌঁছোলুম নৌকোর একতলাটি একটি ছোটখাটো মেরামতি কারখানা সেখান থেকে আধতলা উঠে গেলেই একটি করিডোরের দুইপাশে বিলাসবহুল কেবিন রয়েছে কয়েকটি তার উপর ঢাকা ডেকসহ রেস্তোঁরা নাচউঠোন একেবার উপরতলায় খোলা ডেক, নদীর সঙ্গে, হাওয়ার সঙ্গে  একাত্ম হয়ে যাবার আয়োজন করা আছে সেখানে

ঢাকা ডেকটিতে বসে বৃষ্টির ছাঁট উপভোগ করি, নৌকো ছাড়ারও প্রতীক্ষা রয়েছে সেই জলসম্প্রপাতের ঝালরের ভিতর দিয়ে একদিকে দেখি দূরে সরাইঘাট ব্রিজ সরাইঘাটে নদী সব থেকে ক্ষীণতনু, মাত্র এক কিমি তার উপর ১৯৬২ সালে তৈরি হয়েছিলো দেড় কিমি দীর্ঘ রেল সড়ক সেতু ব্রহ্মপুত্রের উপর প্রথম সড়ক রেল পারাপার সংযোগ সরাইঘাট অহোম সংস্কৃতি বীর্যবত্তার এক উজ্জ্বল গৌরব পর্ব এইখানেই সপ্তদশ শতকে অহোম রাজ চক্রধ্বজ সিংহের বীর সেনাপতি লচিত বড় ফুকনের রণকৌশল বীরত্বে মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের  বিপুল, দুর্জয় সৈন্যবাহিনীকে পরাজয় স্বীকার করে ফিরে যেতে হয়েছিলো  দেশের অন্যপ্রান্তে প্রায় সমসময়ে মরাঠারাজ ছত্রপতি শিবাজী একই রণকৌশলে মুঘল সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন ইতিহাস তাঁকে  উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছে কিন্তু লচিত বড় ফুকনের বীর্যবত্তার কথা আমাদের ক’টা পাঠ্যপুস্তকে  রয়েছে?

ওখান থেকে একটু এগিয়ে গেলেই হাজোতে মণিকূট পর্বতে রয়েছে  হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধদের নানা উপাসনাস্থল ১৫৮৩ সালে স্থাপিত হয়গ্রীব মাধব মন্দির, আদতে একটি বিষ্ণু মন্দির, কিন্তু বহু স্থানীয় বৌদ্ধদের বিশ্বাস,  গৌতমবুদ্ধের নির্বাণপ্রাপ্তি এখানেই হয়েছিলো এছাড়া রয়েছে ১৬৫৭ সনে শাহজাহানের কালে নির্মিত হাজো পোয়া মক্কা মসজিদ

হঠাৎ জাহাজের ভোঁ বেজে ওঠে বৃষ্টিও ধরেছে ততক্ষণে বাঁধনহারা জলস্রোতের দুইপারে নীলসবুজ পাহাড়গুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গোধূলির নিভন্ত আলোয় ধীরে জাহাজ জেটি ছেড়ে মাঝনদীর দিকে এগিয়ে যায় নদীর উত্তরের তটরেখা কাছে আসে, ব্যস্ত দক্ষিণ পারের দিকে তাকাই এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে সারি সারি ছোট বড় নৌকোর  তীরের পাশে ছলাৎছল দুলে যাওয়া দেখি নদীর বুক চিরে নানা মাপের কত নৌকো এপার থেকে ওপার চলে যাচ্ছে হাঁসের মতো মসৃণ অনায়াস লেবুজলে ভদকা মিশিয়ে দিয়ে যায় একজন তাকে নিয়ে তেতলার খোলা ডেকে গিয়ে বসি উথালপাথাল হাওয়া, রেণুমত্ত জলকণা আর মেঘমগ্ন দিগন্তে ধীরে রং জাগছে গোলাপমায়ার সেখানে বসে প্রিয় মদিরার স্বাদ নেওয়া; বুর্জোয়া বদমাশের একশো ভন্ডামির উপর একশো এক গাল দিতে হয় পরে দিও, কিন্তু এখন আমি নিজের সঙ্গে একা ফোনে বন্দি উস্তাদদের থেকে রাশিদকে বাধ্য করি আমাকে রাগ দেশ শোনাতে ক্যামেরায় চুমুক দিই জল-আকাশে আর ঠোঁটে চুমুক শীতল বারুণীর নির্যাস

...ওপারেতে বৃষ্টি পড়ে
ঝাপসা গাছপালা
এপারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান...

আঁধার ক্রমে আসিতেছে একেকটা পাহাড়ের পিছন থেকে ছায়া এগিয়ে আসছে জলের উপর দূর তটরেখা জুড়ে নৌকোর সারিতে টিমটিম করে জ্বলে উঠছে আলো মন্দিরের চূড়ায় জ্বললো শিখরপ্রদীপ জাহাজের শব্দ ছাপিয়ে দূর হাওয়ায় ভেসে আসছে কীর্তনের সুর
ব্রহ্মপুত্রে সন্ধ্যা নামলো
হাতের পানীয় প্রায় শেষ, রাশিদ মধ্য দ্রুত পেরিয়ে দ্রুতে পৌঁছে গেছেন রকম সময়ে মোহমুদ্গর ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না

তবে স্বর্গ থেকে নরকের দূরত্ব খুব বেশি নয় উপর ডেকে ওঠার আগেই দেখেছিলুম ঢাকা ডেকের নাচ উঠোনে কিছু জোগাড়যন্ত্র হচ্ছে একটি বৃহৎ স্পিকারে বেশ কিছুক্ষণ মিয়োনো কণ্ঠস্বরে আধা পঞ্জাবি আধা রাজস্থানি ভাষায় গান জাতীয় কিছু বাজছিলো বিশ বছর আগে যে সব মূর্খামি চলতো গজলের নামে, এখন তাকে বলে সুফি সে রকমই কিছু বিড়ম্বনা বাতাসে ভাসছিলো নিরাপদে সেটি থেমে যাবার পর ডেকচেয়ারটিতে বেশ হেলান দিয়ে বসলুম হঠাৎ কর্ণবিদারী  কোলাহলে বেজে উঠলো, ‘ছম্মক ছল্লো... এই আপদটির  কথা লোকমুখে শুনেছিলুম আগে, এখন কান দিয়ে বা প্রাণ দিয়ে শুনতে শুরু করলুম লঞ্চসেবকরা জানালেন নিচে নাচের ব্যবস্থা হয়েছে, আমরা ভারতমাতার সুসন্তান হলে যেন অবিলম্বে সেখানে গিয়ে যোগ দিই হুড়মুড় করে খোলা ডেকের সুসন্তানরা নিচে নেমে গেলো আমি কুসন্তান হয়ে খানিকক্ষণ বসলুম অন্ধকারে কিন্তু ক্যাকোফোনি অসহ্য হয়ে উঠতে গুটি গুটি নিচে নামি সেখানে দেখি বেশ কয়েকটি পরিবার নৈশাহারসহ নৌকোবিহার পালায় সামিল এবং সারা উঠোন জুড়ে তুমুল নেত্য করে চলেছেন এই গণনেত্য কার্যক্রমের বিশেষত্ব হচ্ছে, পরিবারের মহিলা কন্যারা উচ্ছ্বসিত উৎসাহে নৃত্যপরা তাঁরা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের রীতিমতো টানাটানি করছেন নৃত্যে সামিল হবার জন্য, কিন্তু কেউই সলমান খান হতে রাজি নয় আমার সঙ্গি এক দ্রাবিড় সহকর্মী আমাকে বারম্বার অনুরোধ করছিলো যেন আমিও দেশের সম্মানরক্ষায় নেত্য করি আমি রাজি না হওয়ায় সে বিশেষ দুঃখ করে বলতে থাকলো নেহাৎ তার অতি স্ফীত মধ্যদেশের জন্য সে নিজে নাচতে পারছে  না আমার মতো 'ফিগার' হলে সে এতক্ষণে আগুন ছুটিয়ে দিতো আমি বুঝলুম মনে মনে সে হুইস্কির আগুনে জ্বলে নিজেকে শিবাজিরাও গাইকোয়াড় ভাবতে শুরু করে দিয়েছে একের পর এক বেজে চলেছে ফিলিমে হ্রস্ববসনা সুন্দরীদের আইটেমগানা আর সামনে স্থূলাঙ্গিনী, পীনবদনা ঊর্বশীদের নৃত্য

তবে সব রাতের শেষেই যেমন ভোর হয়, তেমনি একসময় থেমে গেলো সেই রণরলরোল শ্রান্ত সুন্দরীরা ঝর্ণাধারার কাকলির সুরে হাস্যপর এবং সঙ্গী পুরুষরা যে কত অপদার্থ সেকথা উচ্চকিত হয়ে নদীকে জানিয়ে যাচ্ছিলেন নৌকো ধীরে ধীরে ভিড়ছিলো তীরের দিকে ফিরে এসেছিলো নীরবতা আর ঢেউয়ের শব্দ উত্তরপাড়ের পাহাড়গুলি অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সরাইঘাট সেতুর থেকে ঝিকিমিকি নিভু নিভু আলো দক্ষিণপাড়ের শিবমন্দিরের আলো নদীর জলে দীর্ঘ রশ্মিরেখা টেনে চলেছে

এবার ফেরার সময় হলো

...নদীর রক্তিম বেগ সূর্যাস্তের ইন্দ্রধনুচ্ছটা
পাহাড়ের ঢেউ- লেগে চূর্ণ চূর্ণ ছড়ায় আকাশে
নোনা ক্ষিপ্র জলে স্থির দূর বনরেখায়, বিলাসে
ছন্নছাড়া চলে যায় ত্রস্তস্নায়ু আঁধারে কুলটা
রাত্রির আসরে অন্ধ, ...

(সূর্যাস্তঃ বিষ্ণু দে)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন