কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

শুক্লা মালাকার

সূতো


তপস্বীর মতো মুখ ভক্তি চুঁয়ে নামছে দু’চোখ বেয়ে ভক্তিভরে কালীমন্দির দর্শন   করে লাইনে দাঁড়াল সনাতন মাকে মন্দিরের কাছাকাছি একটা দোকানের পাশে বসিয়ে এসেছে যা লাইন, পুজো দিতে একঘন্টার বেশি লাগবে মাকে একটু খেয়াল  রাখতে বলে এসেছে দোকানীকে সকাল থেকে জলটুকুও মুখে তোলেনি মা কালীঘাটে পুজো দেবে তা মায়ের সারা জীবনের পুণ্যি ভোর ভোর বেরিয়েছিল গাঁ থেকে বড় রাস্তা অব্দি আলপথে হেঁটে এসেছে তারপর ভ্যানে চেপে ইস্টিশন সেখান থেকে ট্রেনে হাওড়া কালীঘাট পৌঁছোতে একটা বেজে গেছে

মা প্রথম থেকেই সিটিয়ে ছিল এক গাঁ থেকে বিয়ে হয়ে আর এক গাঁ, ব্যাস মায়ের দৌড় ওই অব্দি বড় রাস্তাতেও ওঠেনি কোনোদিন উঠোন, ঘর, ক্ষেত, গোয়াল,  পুকুরঘাট আর চারছেলে নিয়েই তার জীবন সনাতন তখন আট ক্লাস পাশ দিয়ে সবে ক্ষেতে যেতে শুরু করেছে একদিন দুপুরে খাবার সময় শুনেছিল মা বাবাকে  বলছে তার বড় ইচ্ছে একবার কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দেবে বাবা হেসে বলেছিল কালীঘাটে যেতে গিয়ে ভিরমি খেয়ে পড়বে হলোও তাই হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে  মা পুরো তলিয়ে গেল হাতে পুঁটুলি আর একবুক আতঙ্ক নিয়ে ছোটছেলের হাত আঁকড়ে ধরেছে সনাতনের বত্রিশ বছর বয়সে প্রথম মায়ার মাথা ঘোমটা ছাড়া দেখল খেয়ালও নেই তিরতির কাঁপছে শরীর, চোখের পাতা


সনাতনও খুব বেশি আসেনি কলকাতায় জিজ্ঞেসা করে কালীঘাটের বাসে মাকে  নিয়ে উঠল  ভিড়ে ঠাসা বাস কলকাতার কোলাহল, ঝাঁকবাঁধা লোক, গাড়ি দেখে সনাতনই ভ্যাবলা মতো হয়ে যায় মায়ের মুখ চালসে রঙা হয়ে গেছে  কালীঘাটের মন্দির দেখে কোনোরকমে দু’হাত তুলে মাথায় ঠেকিয়েছে

চারভাই মিলে যখন কথা হচ্ছিল সনাতনই বলেছিল মাকে কালীঘাটের মন্দির দেখানোর কথা বাকি সবাই খুশী খুশী রাজি হয়ে গেছিল বাবা মারা গেছে চারমাস হলো সেই থেকে মা কেমন থম ধরে গেছে জমি-জিরেত চারভাই ভাগাভাগি করে  নিয়েছে ঠিকই কিন্তু  মনোমালিন্য হয়নি মোটেই মায়ের দায়িত্ব চারভাই  মিলেমিশেই পালন করে সেদিক থেকে মায়ের নাতিনাতনি ভরা সুখের সংসার হিংসুকেরা বলে জমি-ঘরবাড়ি কত্তাবাবু লিখে দিয়েছিল বলেই গিন্নির এত যত্ন-আত্তি  মায়ের সই ছাড়া ভাগাভাগিতে আইনের ছাপ পড়বে কী করে?
একনিষ্ঠ আকুতি নিয়ে মা অপেক্ষায় আছেন কালীঘাটের মায়ের দর্শন করে তাঁর  ভরা সংসারের জন্য মঙ্গল কামনা করবেন ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা খানিক কমেছে তো আর গাঁয়ের শীতলা থান না যে যাব আর পুজো দিয়ে ফিরবো! সনাতন বলেছিল  কত দূর দূর থেকে কত কত লোক আসে নিজেদের মনোকামনা নিয়ে ট্রেনে ওঠা থেকেই তো দেখছেন খালি লোক আর লোক এত লোক তাদের দশ গাঁ মিলেও হবে না বোধহয়

রাত ন’টা পেরিয়ে যেতে দোকানী এসে বলল - আপনার ছেলে তো এখনো এলো না মাসীমা! – মা থতমত খেলেন বাসগাড়িতে শুনেছেন এখানকার লোকেরা কেমনতর কথা বলে বুঝতে পারছেন না ভালো করে চুপ করেই থাকলেন দোকানী আবার বলল - পুজোয় দেবার জন্য কাপড় কিনবে বলে গেল, কিছু হলো না তো?  


মা সব কথা বুঝতে পারছেন না মনে মনে শুধু সনাতন, বাবলু, গোবরাকে ডাকছেন তার চারপাশে ভিড় বাড়ছে, তিনি সিদোচ্ছেন  তাঁর মাথার ওপর বুক  চিতিয়ে পড়ে থাকা কুড়ি বিঘা ফসলি জমি, দালান-উঠোন, লাউ-পুঁইমাচা, পুকুর, মড়াই ভর্তি ধান, গোয়াল, আমবাগান, তুলসিতলা - একহাঁটু দু’হাঁটু করে করে ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছেন পাঁকে

জঙ্গিপুর যাবার ট্রেনে একঠোঙা ঝালমুড়ি চিবোতে চিবোতে সনাতন মুচকি মুচকি হাসছে এবার দাদাদের তার আটক্লাস পাশের জন্য বাহবা দিতেই হবে কত সহজে শেষ সুতোটা ছিঁড়ে ফেলা গেল! ভাগের সম্পত্তিতে নিজেদের নামের পাশে আইনের মোহর পড়ল বলে!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন