কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

তুষ্টি ভট্টাচার্য

পতিত পাবনী গঙ্গে



পতিত পাবনী গঙ্গে... গঙ্গাকে আমি ঠিক এভাবে দেখি নি, ভাবি নি কোনদিন। আসলে আলাদা করে গঙ্গাকে নিয়ে ভাবার অবকাশ হয় নি। গঙ্গার বুকের ওপর দিয়ে একসময়ে হাল টানা নৌকোয় চড়েছি, এখন গঙ্গা পেরোই ভটভটিতে। জোয়ারের সময়ে এর চকচকে চেহারাটা বেশ টানে আমাকে। কিন্তু ভাটার সময় ঘোলা জল থেকে দূষণের গন্ধ উঠে আসে, তখন মুখ ফেরাতে ইচ্ছে হয়ভাদ্র মাসে কোটালে-এর যা রূপ দেখি... একটু থমকাতে হয় তখন। এত এত জল কোথা  থেকে আসছে বুঝতে পারি না। ভীষণ এক স্রোতে ভেসে আসছে কাঠকুটো, দেবীর কাঠামো, জংলা গাছপালা, মায় গরু-ছাগল বা মানুষের লাশও! তবে বিকেলে সূর্যাস্তের সময় গঙ্গার ধারে কাটানো একটা অভিজ্ঞতা। সূর্যের লাল আভা মাখা নদীর জল, দু’পাড়ের ল্যান্ডস্কেপ, সঙ্গে ফেরি পারাপার... একটা সিলুয়েটের মত। এক দক্ষ  শিল্পী তাঁর নিপুণ তুলির টানে রোজ রোজ এই চিত্র এঁকে চলেছেন, যা কিন্তু কোনভাবেই একঘেয়ে হয় না। আর শীতের ভোরে কুয়াশায় গঙ্গার মধ্যে নৌকোর পার খুঁজে না-পাওয়া? সেও এক অভিজ্ঞতা। বেলা আটটা বেজে গেলেও কুয়াশার প্রকোপে পার দেখা যায় না তখন। ওপার থেকে মাঝি মাল্লারা হাঁক দেয়, সেই শব্দ শুনে শুনে নৌকো এগিয়ে চলে ধীরে ধীরে। দিনে-দুপুরে অলস সময়ে কখন যেন একের পর এক শুশুক ভুস করে জেগে ওঠে, আবার মিলিয়েও যায়। আর রাতে, সে চাঁদ থাকুক বা না-থাকুক, এখন তো দুপারের আলোতেই গঙ্গা আলোকিত হয়ে গেছে, তাই মহিমা একটু কম। অনেক অনেক দিন আগে যখন ইলেক্ট্রিসিটির জোর এত বাড়ে নি, তখন আধো আলোর মধ্যে, সে তারার হোক বা চাঁদের, সঙ্গে ছপাত ছপাত বৈঠা পড়ার শব্দ যেন চারিদিকের জল থৈথৈ নৈঃশব্দের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে, ঘুম ভাঙছে না জলের আর আমাদের কান আরও সজাগ হয়ে ভয় মিশ্রিত ছমছমে পারলৌকিক এক জলবিহারের সাক্ষী থেকে যায়। সে যাইহোক, জল দূষণের মাত্রা হয়ত একটু কমের দিকে এখন, অনেক জায়গাতেই পলি তুলে নদীর নাব্যতা বাড়ানো হয়েছে। দুপাড়ে জেটি বসেছে। দু’পাড় সেজেছে বাহারী আলোয়,  গাছে, বসার ব্যবস্থায়। নইলে গঙ্গার পাড়ে যেভাবে কাঠামোর স্তুপ আর প্রাতঃকৃত্যকারীদের দৌরাত্ম্য ছিল, সকাল বিকেলে হাওয়া খাওয়া ছিল তখন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে পড়া। নাকে কাপড় দিয়ে পালানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না।



ভৌগলিক গুরুত্বের দিক থেকে গঙ্গাকে অস্বীকার করার কোন উপায় আমাদের, গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসবাসকারী মানুষদের নেই। ২,৫২৫ কিমি দৈর্ঘ্যের গঙ্গা নদী পশ্চিম হিমালয়ের গোমুখ হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যা কিনা উত্তরাখন্ড রাজ্যে অবস্থিত। এরপর দক্ষিণ ও পূর্ব অভিমুখে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকা দিয়ে নেমে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা নাম নিয়ে। এবং এখানেই বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। গঙ্গা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম নদী। দেবী গঙ্গা রূপে হিন্দুরা যেমন এই নদীকে পবিত্র নদীর আখ্যা দিয়েছে, তেমনি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম না। বেশ কিছু শহরের প্রাক্তন এবং বর্তমান রাজধানী এই গঙ্গার ধারেই গড়ে উঠেছে। যেমন কনৌজ, কাম্পিল্য, কারা, প্রয়াগ, এলাহাবাদ, কাশী, পাটলিপুত্র, পাটনা, হাজিপুর, মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, নবদ্বীপ, সপ্তগ্রাম, কলকাতা, ঢাকা,  ইত্যাদি। ব্যবসা, বাণিজ্য, যাতায়াত, চাষবাস, এরকম নানা দিক রয়েছে, যে কারণে এই গাঙ্গেয় উপত্যকা মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও সুফলদায়ী হয়েছে, তাই এখানকার লোকবসতিও অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বেশি।

হিমালয়ের সরু উপত্যকা দিয়ে ২৫০কিমি যাওয়ার পর গঙ্গা ঋষিকেশ-এ পার্বত্য অঞ্চল থেকে সমতলে নামে। হরিদ্বারে গঙ্গার আরাধনা করা হয় ধুমধাম করে। আবার এই হরিদ্বারেই বাঁধ দিয়ে গঙ্গাকে বেঁধে ফেলাও হয়েছে! যেন মানুষই নদীকে দেবী বানিয়ে, নিজের প্রয়োজনে তাকে কাজে লাগিয়ে নিচ্ছে। গঙ্গার কিছু জল গ্যাঞ্জেস ক্যানেল হিসেবে দোয়াব অঞ্চলে সেচের জন্য বইয়ে দেওয়া হয়েছে। আর জলবিদ্যুৎ তৈরি তো হচ্ছেই। ফলে খরস্রোতা গঙ্গা এখানে এসে স্রোত হারিয়েছে মানুষের প্রয়োজনে।  

এরপর ধনুকের জ্যার মত ৮০০ কিমি পথ বয়ে গেছে কনৌজ, ফারুখাবাদ ও কানপুরের ওপর দিয়ে। এখানে গঙ্গা রামগঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়, যে নদী বার্ষিক ৫০০ মিটার কিউব পার সেকেন্ড জল দেয়। এলাহাবাদের পুণ্য ত্রিবেণী সঙ্গমে গঙ্গা  যমুনার সঙ্গে মিলেছে। যমুনার থেকে প্রায় ২৯৫০ মিটার কিউব পার সেকেন্ড অর্থাৎ প্রায় ৫৮.৫% জল এই মিলিত স্রোত থেকে পাওয়া যায়।



পূর্ব দিকে বয়ে যাওয়ার সময়ে গঙ্গা তমসা নদীর সঙ্গে মেশে। এরপর গোমতী এসে মিশেছে। তারপর ঘরঘরা নদী, যে নদী নেপাল থেকে এসেছে। এরপর সোন নদী, গন্ডকী নদী, কোশি নদী নেপাল থেকে এসে একের পর এক গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে। ঘরঘরা নদীর পর কোশি নদীই গঙ্গাকে সব থেকে বেশি জল দিয়ে এসেছে।

ভাগলপুরের কাছে পাকুরে এসে গঙ্গা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে। প্রথম শাখা নদী হিসেবে ভাগীরথী-হুগলী বা হুগলী নদী নামে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। ফারাক্কার বাঁধ বাংলাদেশের সীমান্তে গঙ্গার জল প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু জল  হুগলী নদীতে বইয়ে দেয়, বাকি চলে যায় পদ্মায়। এই হুগলী নদীও ভাগীরথী ও নবদ্বীপের কাছে জলংগী নদীর মিশেলে তৈরি। ডায়মন্ড হারবার ৫৪১ কিমি দীর্ঘ, ২৫,৮২০ স্কোয়ার কিমি নিকাশি বেসিন রয়েছে যার, হুগলী নদীকে সব থেকে পুষ্ট করেছে। ডায়মন্ড হারবারে গিয়ে যে জাহাজ দেখেছে, জাহাজে ভোঁ শুনেছে একবার, তার সুদূরের ডাকের হাতছানি অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এ জীবনে হবে না বলে আমার বিশ্বাস। সাগর দ্বীপের কাছে হুগলী নদী বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। মালদা থেকে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে হুগলী নদী মুর্শিদাবাদ, নবদ্বীপ, কলকাতা ও হাওড়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। 



আর পুণ্যতোয়া, পতিত পাবনী গঙ্গাকে নিয়ে যেসব পৌরাণিক কাহিনী চালু আছে তার অনেকটাই আমাদের জানা। যেমন - কথিত আছে জ্যৈষ্ঠ মাসের দশমীর দিনে  গঙ্গা স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। দশহরার এই পুণ্য দিনে গঙ্গাস্নান করলে দশ জন্মের পাপ দূর হয়। এই অবতরণ নিয়ে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন রকম কাহিনী প্রচলিত আছে। বৈদিক মতে বলা হয়, স্বর্গের রাজা ইন্দ্র বৃত্রা নাম্নী স্বর্গীয় এক বিশাল অজগরকে  হত্যা করেন। আর তার ফলে সেই সাপের শরীর থেকে যে সোম রস নির্গত হয়, তাই মর্তে পৌঁছে গিয়ে কালে দিনে গঙ্গার রূপ নেয়। বৈষ্ণব মতে স্বর্গের রাজা হলেন বিষ্ণু। বামন অবতার কালে স্বর্গের সিন্দুকে পায়ের আঙুল দিয়ে গর্ত করে বিষ্ণুপদীকে উদ্ধার করেন। উদ্ধার হওয়ার পরে বিষ্ণুপদী ইন্দ্রর স্বর্গপুরী থেকে নীচে নেমে আসেন আর সর্বপ্রথম তাঁকে স্বাগত জানান ধ্রুব, যিনি  আবার বিষ্ণুর অন্যতম ভক্ত। এই ধ্রুবকে তিনি আকাশে অক্ষয় ধ্রুবতারা করে দেন আর তারপর তৈরি করেন ছায়াপথ। এরপর চাঁদে পৌঁছে যান। এরপর মেরু পর্বত থেকে ব্রহ্মার স্বর্গীয় পদ্মের পাপড়ি নিয়ে পৃথিবীর দিকে নেমে আসেন। পৃথিবীতে নেমে বিষ্ণুপদী দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। অলকানন্দা ও গঙ্গা নাম নিয়ে দুই নদী জন্ম  নেয়।  

কিন্তু রামায়ণ, মহাভারত এবং অন্য পুরাণে গঙ্গার অবতরণ নিয়ে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, সেটিই গ্রহণযোগ্য হয়েছে আমাদের কাছে। সাগর রাজার ষাট হাজার ছেলের অত্যাচারে কপিল মুনির বারবার ধ্যান ভঙ্গ হচ্ছিল। এক সময়ে রাগে  অগ্নিশর্মা হয়ে এই ছেলেদের তিনি শাপ দিয়ে ভস্মে পরিণত করেন। এবং এই ভস্ম তিনি পৃথিবীর বাইরে নিক্ষেপ করেন। একমাত্র গঙ্গার জলই এই ভস্মকে প্রাণ দিতে পারত, এই কথা জেনে সাগর রাজার বংশধর ভগীরথ কৈলাশ পর্বতে গিয়ে শিবের সাধনা শুরু করেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর জটা থেকে গঙ্গাকে নিষ্ক্রমণ করেন। গঙ্গা হিমালয়ে নেমে আসেন। ভগীরথ তাঁকে পথ দেখিয়ে হরিদ্বারে নিয়ে আসেন। প্রয়াগ এবং বারাণসীতে গঙ্গা যমুনার সঙ্গে মিলিত হন। শেষে গঙ্গাসাগরে এসে গঙ্গা সাগরে মিশে পৃথিবীর বাইরে চলে আসেন। এই সময়েই সাগর রাজার পুত্রদের মুক্তি ঘটে। ভগীরথের এই ভূমিকার জন্য গঙ্গার আরেক নাম হয় ভাগীরথী।  

গঙ্গাকে আবার তিন প্রধান দেবতার সঙ্গিনী বলা হয়ে থাকে। ব্রহ্মার সঙ্গিনী হিসেবে গঙ্গা সবসময়ে ব্রহ্মার কমন্ডুলে থেকেছেন। আর শিবের জটার থেকে গঙ্গার উৎপত্তির কথা তো আমরা জানিই। বিষ্ণুপদীকে বিষ্ণু যে শুধু মুক্ত করেছেন তা না, সরস্বতী ও লক্ষ্মীর সঙ্গে গঙ্গাকেও তিনি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছেন। এখানে অবশ্য একটা ঝগড়ার গল্প আছে। বলা হয়ে থাকে, একদিন গঙ্গা ও সরস্বতী তুমুল ঝগড়ায় মেতেছিলেন, লক্ষ্মী বরাবরের লক্ষ্মী, অনেক চেষ্টা করেও ওঁদের থামাতে পারেন নি। সেই সময়ে বিষ্ণু ফিরে এসে দুই বউয়ের ঝগড়া দেখে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে শাপ দেন। সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী রূপে থাকতে বলেন ও গঙ্গাকে শিবের স্ত্রী হয়ে। এবং এই দুই নদী মর্তে অবতরণ করলে ওখানকার সমস্ত পাপীতাপীদের পাপ ধুয়ে যাবেন সারা নদী-জীবন ধরে। যদিও বিষ্ণুর এই রাগে দুই বউ আরও ঝগড়াঝাঁটি শুরু করেন। এবং শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুর কাছেই থেকে যান। যদিও সেই কথনের সূত্র ধরে আমরা গঙ্গাকে শিবের, আর সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী রূপেই চিনি। 




যাই হোক না কেন, গঙ্গাকে নিয়ে বেশি রকম ভাবনা আমার মনে নেই। এ তো আমার ঘরের লোক! আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। আমার মৃত্যুর পরে এই গঙ্গার বুকেই আমার অস্থি বিসর্জন হবে, এও জানা আছে। ইলেক্ট্রিক চুল্লী হয়ে গেছে তাই, নইলে গঙ্গার তীরে দাউদাউ চিতার আগুনে পুড়ছি আমি, এই চিত্রটিও মনে গাঁথা ছিল। সে আর সম্ভব নয়, ট্রের ওপর চড়ে শেষ যাত্রা সম্বল। তবে ছাইটুকু বুকে নিয়ে নেবে এই গঙ্গাই, এই আমার শান্তি, এই আমার প্রাপ্তি। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন