কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৫৪  


গত ১৭ ও ১৮ মার্চ ২০১৮ জামশেদপুরের ৪৫ বছরের প্রবীণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘সৌরভ’এর ৪৩তম বাৎসরিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো সম্প্রতি নির্মিত সৌরভের নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহে। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ছিল সাহিত্য অধিবেশন ও দ্বিতীয় দিন সৌরভের ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছরের মতো এবছরও সাহিত্য অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি-বক্তা একটি নির্দিষ্ট সাহিত্য বিষয়ের ওপর দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে ছিল উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে অতিথি-বক্তার অভিমত বিনিময়। এবছর সৌরভের অতিথি-বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক ড. অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য বিষয় ছিল ‘ভারতীয় সাহিত্যে রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতিফলন’। তাঁর সুদীর্ঘ বক্তৃতা একইসঙ্গে ছিল প্রাঞ্জল ও তথ্যসম্ভারে সমৃদ্ধ। বিশেষত তাঁর বক্তব্যে যে কথাটা আমাকে তাড়িত করল, আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করি, ভালোবাসি, সমাদর করি, তারা নিজের মাতৃভাষায় লিখিত সাহিত্যের বাইরে কতটা ওয়াকিবহাল আমাদের প্রতিবেশী ভাষায় লিখিত সাহিত্য সম্পর্কে? আমরা নিজেদের ভারতীয় পরিচিতি পর্যায়ে সচেতন এবং সেজন্য গর্ব বোধ করি, অথচ একই দেশের বিভিন্ন ভাষার লেখকদের নাম ও তাদের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে আদৌ কোনো খোঁজখবর রাখি না। এবং এটা শুধুমাত্র সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক যে কোনো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটা তো আমাদের অসম্পূর্ণতা! ব্যর্থতাও বলা যেতে পারে। আসলে আমরা নিজেদের ভারতীয় বা আরও সাহসী হয়ে নিজেদের আন্তর্জাতিক মনে করলেও প্রতিবেশী ভাষাভাষী মানুষদের হাল হকিকত জানি না। জানার আগ্রহ বোধ করি না। বিশেষত সাহিত্য  ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে। অধ্যাপক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই, সেদিনের বক্তৃতায় তিনি আমাদের এই অনাগ্রহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।


বিগত ১৭ মার্চ ২০১৮ তারিখে ‘সৌরভ’এর সাহিত্য অধিবেশনে আরও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, যা বিশেষ কারণবশত স্থগিত রাখতে হয়েছিল। এবছর ভারত সরকার সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. দিগম্বর হাঁসদাকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করেছেন। তাঁর এই সম্মান প্রাপ্তিতে ‘সৌরভ’এর পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করা হয়েছিল কিন্তু  অধ্যাপক হাঁসদা সেদিন জামশেদপুরে উপস্থিত না থাকায় অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে হয়েছিল। প্রসঙ্গত জানাই, অধ্যাপক হাঁসদা রাজনীতি বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে দীর্ঘদিন জামশেদপুরে একটি কলেজে অধ্যাপনা করে অবসর গ্রহণ করেছেন। সেইসঙ্গে সাঁওতালী ভাষা ও সাহিত্যের সৃজনশীল কাজে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত রেখেছেন। সাঁওতালী সাহিত্যে তাঁর অবদান ‘সরনা গদ্যপদ্য সংগ্রহ’, ‘সাঁওতালী লোককথা সংগ্রহ’, ‘ভারতীয় লৌকিক দেবদেবী’, ‘গঙ্গমালা’ ইত্যাদি অমূল্য গ্রন্থরচনা। এছাড়া সাঁওতালী ভাষায় ভারতীয় সংবিধানের অনুবাদ তাঁর একটি অনন্যকর্ম। অধ্যাপক হাঁসদা জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিহার রাজ্যের (বর্তমানে ঝাড়খন্ড রাজ্য) সিংভূম জেলার জামশেদপুর মানগো স্থিত বেকো অঞ্চলের ডোবাপানি গ্রামে ১৬ অক্টোবর ১৯৩৯ সালে। বর্তমানে তিনি জামশেদপুরে করণডি অঞ্চলে বসবাস করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী অনুসন্ধান সংস্থার সক্রিয় সদস্য। ‘কালিমাটি’ পত্রিকার পক্ষ থেকে অধ্যাপক হাঁসদাকে জানাই শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন। কামনা করি তাঁর নীরোগ ও সুস্থ জীবন।


বাংলা নতুন বছর শুরু হবার প্রাক্কালে প্রকাশিত হলো ‘কালিমাটি অনলাইন’এর ৫৪তম সংখ্যা। সবাইকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।    


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :  
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675
                                                        
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India




<<<< কথনবিশ্ব >>>>


শিবাংশু দে




কুশারিবাগান-




একটা নেশার মতো সেই ছোটোবেলা থেকে আলাদা করে ভাবিনি কখনও কিন্তু জায়গাটা ছিলো যেন একটা মুক্তির প্রান্তর তার ঝকঝকে আকাশ, লাল মাটির দিক ছাড়ানো উঁচুনিচু কার্পেট তাল আর খেজুরগাছের সঙ্গে বাঁশবাগান, অকুলীন লতাগুল্ম সবুজ জাগিয়ে রাখে কৃপণ হলেও উজ্জ্বল ছোটো ছোটো বাড়িঘর, নম্র, সহৃদয় মানুষজন আর সহজ, উচ্ছল কিশোরীদের অনায়াস মুখরতা অবারিত অক্সিজেন, ক্লোরোফিল আর ভিটামিন ডি নিজেকে আচরাচর ছড়িয়ে বাঁচার মানেবই খোলা থাকে চারদিকে আমাদের গ্রামের থেকে অন্যরকম ছোটোবেলা থেকে দেখছি টাটাবাবা তার জমিদারি ঘিরে রাখে জবরদখল বাঁচাতে অতো চেনা মাঠপ্রান্তর, পথঘাট, তাদের উদাত্ত উন্মুক্ততা হারিয়ে ফেললো রূঢ় লালফিতের বাঁধনে তবে কি আমাদের চেনা  শান্তিনিকেতনও একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছে সেই সব চরিত্র, যার টানে যে কোনও সময় নির্ভার ছুটে যাওয়া যেতো! চুপ করে কোপাই, খোয়াই,  তিনপাহাড়ের কোণায় বসে নিঃশব্দের গান শুনে জমে যেতো নেশার মৌতাত!  সরজমিন জানার ইচ্ছে হয় কেমন আছে সেই দূর রজনীর স্বপন? দূর ফাগুনের বেদন উদযাপন করতে না হয় আরো একবার ভুবনডাঙ্গাই হোক প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ যদি পাই, ছাতিমতলায় তার অফুরান আয়োজন কী আর কিছু বেঁচে আছে?

বাড়ি থেকে রেলগাড়ি ধরতে যখন বেরোলুম তখনও শুকতারা জ্বলজ্বলে কৃষ্ণকলি ভোরে শিরশির বয়ে যাওয়া ললিতবসন্তের ফাল্গুন যাবো নিশ্চিন্তিপুর

হাওড়া স্টেশনে লোকজন দেখে সময় কেটে যায় অগণন মানুষের এরকম একটি বর্ণময়, ছন্দময় কোলাজ আমি তো কোথায় দেখিনি শাশ্বত চলমান ইনস্টলেশন শিল্প এক মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি নেই তার বোলপুরের লাইনে এখন অসংখ্য রেলগাড়ি সেই দানাপুর প্যাসেন্জার বা রামপুরহাট ঠ্যালাগাড়ির আঠেরো  শতকের বিলাস আর নেই তাদের মধ্যে নবীনতম নিউ জলপাইগুড়ি শতাব্দী একটা সরেস গাড়ি নতুন, আরামপ্রদ এবং বিন্যস্ত বোলপুর পর্যন্ত থামে না কোথাও, এমনকি বর্ধমানেও না সোয়া ঘন্টায় পৌঁছে যায় গন্তব্যে মসৃণগতিতে গাড়ি এগিয়ে যায় বর্ধমান পেরিয়ে যায়, গুসকরা পেরিয়ে যায় নিঃশব্দে, না থেমে, ভাবা যায়? আশেপাশে নানা মডেলের শান্তিনিকেতনী কিছু খ্যাত-অখ্যাত সহযাত্রীদের দেখি বাঙালি, কিন্তু আন্তর্জাতিক জ্যোতি আছে তাঁদের কারো কারো অজয় ব্রিজের ঝমঝমের মধ্যে বাজনদারের ঝাঁঝ-ঢোলকের স্বাগত সিম্ফনি গাড়ি থামলো, নীচু প্ল্যাটফর্ম ঠিক যেমন দেখেছি তিরিশ বছর আগে




বোলপুর স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়েই সেই ঘিঞ্জি বাজারের রাস্তা মহর্ষির সময় থেকেই তার কোনো স্ফীতিবৃদ্ধি হয়নি মনে হয় শান্তিনিকেতনের মতো একটা  আন্তর্জাতিক ঠিকানাকে ধারণ করার বিন্দুমাত্র পরিসর নেই এই রাস্তাটিতে পুরনো বারাণসির পথঘাটের থেকেও শীর্ণ, সঙ্কুচিত দু'তিনটি মোড়ের গিঁট পেরিয়ে বোলপুর থেকে শ্রীনিকেতনমুখী বড় রাস্তায় কিঞ্চিৎ স্বস্তি সেইপথে চোখে পড়বে কবিগুরু অপটিক্যালস, রবীন্দ্রবস্ত্রভান্ডার বা বিশ্বকবি শু স্টোর্সের সারি তবে একটু চমকে গেলুম পথের ডানদিকে একটি দোকানের নাম দেখে 'পর্ণা হার্ডওয়্যার' নাম তার পর্ণাকে শান্তিনিকেতন মনে রাখবে সেই বিশ্বাস নিশ্চয় ছিলো কিন্তু তা বলে সারি সারি লোহার ছড়, সিমেন্টের বস্তা আর স্যানিটারি ফিটিংসের বেষ্টনীতে ঘেরা পর্ণার মুখটা আর মেলাতে পারলুম না তবে ভরসা আছে, হারায়নি তা হারায়নি, বৈতরণী পারায়নি...

সব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে

বীরভূমের মাটিকাদা, গাছগাছালি, সবার মধ্যেই একটা নিজস্ব আবহের মাত্রা রয়েছে আবহের এই পার্থক্যটি একটু পূর্বদিকে গাঙ্গেয় সমভূমির দিকে গেলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আবার কিছু দক্ষিণপশ্চিমের রাঢ়ভূম, মল্লভূম, মানভূমের সঙ্গেও তার ফারাক বেশ প্রত্যক্ষ মহানগরের কবি, শিলাইদার কবি, আন্তর্জাতিক কবি, সব অবতারগুলিকে মনে রেখেও আমার মনে হয় তাঁর সৃষ্টিকে বীরভূমের ভূপ্রকৃতি যে বিশেষ মাত্রাটি দিয়েছিলো, সেটার অনন্যতা প্রশ্নাতীত ছোটোবেলা থেকে 'শান্তিনিকেতন' বাড়ি, ছাতিমতলা, তিনপাহাড়ের নিশ্চিন্ত পরমার্থকেন্দ্রিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে জীবনের নানা পর্ব ছাড়িয়ে, শ্যামলী পেরিয়ে শ্রীনিকেতনের শ্রমস্বেদসিক্ত কবি সৃজনশীলতার এক ভিন্ন অবয়ব এবং আত্মা আবিষ্কার করেছিলেন আজকে আমরা যে কবিকে চিনি, সেই ধারণাটির ধাত্রী হিসেবে বোলপুর-শান্তিনিকেতন, বৃহদার্থে বীরভূমের রোদ-মাটি-জল তাদের নিজস্ব ভূমিকা খুব সফলভাবে পালন করেছিলো সারা বিশ্ব জুড়ে চোখ ঝলসানো সৃষ্টিবৈভবের সম্রাজ্ঞীরা কবির জন্য নিজেদের সব সম্ভ্রম উজাড় করে যখন রিক্ত, তখন ময়নাপাড়ার কালো মেয়েটি বীরভূমের আলের ধারে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে বেঁধে রেখেছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একটি বিস্ময়কে


তা'সে যতই কালো হোক, ভুল করেনি কবির গহন চোখ....

শান্তিনিকেতনের শান যে সর্ব অর্থেই রবির উপর নির্ভরশীল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মানে, সেখানে শুধু সূর্যবংশীয়দের বাস একটা সূর্য ডুবেছিলো ১৯৪১ সালের অগস্টমাসে, আরেকটা তো রোজই ডোবে কালীসায়রে আর কোপাইয়ের বাঁশবনের পিছনে আঁধারসবুজে মনে হয় এখানে লোকজন সব সৌর শক্তিতে বেঁচে থাকেন পৌষমেলা ছাড়া বছরের আর কোনও সময়ই সাঁঝ নামার পর এখানে পথেঘাটে মানুষজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়না আগে তো ছিলো শুধু হেঁটে বেড়ানো লোকজন, তাঁরাও আঁধার পড়ে গেলে পথে নামতেন না এখন তো অন্ধকার ফুটো করে এক-আধটা দুচাকার আলো ক্বচিৎ কখনও সরু সরু রাস্তায় হুসহাস করে মিলিয়ে যায়। যেহেতু সবাই সবাইকে চেনেন, তাই কাউকে ডানদিকের বদলে বাঁদিকে যেতে। দেখলেই শ্রীযুক্ত '' বলে ওঠেন, কী ব্যাপার? আজ শ্রীযুক্ত '' ওদিকে কোথায় যাচ্ছে খুব যে ঔৎসুক্য আছে , তা নয় তবে " নোট করিয়া রাখা হইলো" গোছের একটা উদ্যম দেখা যায়




আমার ঠাকুরদা ছিলেন সেকালের আগমার্কা নর্থ-ক্যালকাটান বিডন স্ট্রিট, নতুনবাজার, ছাতুবাবুর বাজার প্রথমে ওরিএন্টাল সেমিনারি পরে বেঙ্গল টেকনিক্যাল কলেজ পড়াশোনার বাইরে কার্যকলাপের মধ্যে প্রধান, আদি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে গান শুনতে যাওয়া সাহেবি লোক, বেশ মেজাজি, উগ্র ', তবে সেকালে যাঁদের রাগি বলা হতো, সে রকম, জাঁদরেল মানুষ তাঁর যিনি দাদা ছিলেন, বয়সে অনেক বড়, সেকালের পাস করা ডাক্তার তাঁর শ্রদ্ধেয় গুরু ডাক্তার প্রতাপ মজুমদারের আজ্ঞামতো অ্যালোপাতি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যা', গরিব মানুষদের হোমোপাতি চিকিৎসা করতে তা তাঁদের বিষয়-আশয় ছিলো বেশ ভালো রকম আর তিনি ছিলেন বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটর গোছের মানুষ। সব সময় ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেন অস্ত্র বলতে তুখোড় ইংরিজিতে হুংকার আর একটি দোনলা বন্দুক, সর্বক্ষণের সঙ্গী এই ভদ্রলোকের কথা আমার দাদুর মুখে অনেক শুনেছি বাল্যকালে দাদুর মতো রোয়াবি মানুষও নাকি দাদাকে খুব ভয় পেতেন আমরা বেশ বিস্ময়বোধ করতুম।
বহু বহু কাল পরে আমি তখন দক্ষিণ-পূর্ব সিংভূমে মুসাবনি নামে একটি পাহাড়ি জঙ্গল ঘেরা শহরে দোকান চালাই সেই জায়গাটা এককালে ভারতের তামাব্যবসায়ের রাজধানী ছিলো, কিন্তু আমি পৌঁছোবার আগেই তার জেল্লা অনেক ম্লান। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তামা এদেশে সস্তায় পাওয়া যেতো গৌরব কমে গেলেও ব্রাঞ্চটি ছিলো বেশ বড়ো কারণ অনেক রকম সরকারি-বেসরকারি আপিসদফতর তখনও সেখানে চলমান তা একদিন এক বাঙালি ভদ্রলোক আমার কাছে কিছু কাজে এলেন তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বিভাগে কর্মরত ছিলেন তখন গপ্পো করতে করতে তিনি জানালেন, তাঁর যেখানে আদি বাড়ি সেখানে তখন এক রাজনৈতিক নেতা বড্ডো হুড়দঙ্গ শুরু করেছেন, মানুষের অশান্তির একশেষ তারপর নিজেই বলেন, হয়তো শুনেছেন, জায়গাটার নাম চমকাইতলা আমি বলি, নিশ্চয় শুনেছি আসলে শুনেছিলুম আমাদের আদি বাড়ি নাকি জায়গাটার খুব কাছে কামারপুকুর থেকে বদনগঞ্জ হয়ে পশ্চিমে। হুগলি জেলা যেখানে মেদিনীপুর জেলার  সঙ্গে কোলাকুলি করছে, সেরকম কোনও গণ্ডগ্রাম হবে।
-সে কী? কোন গ্রাম? আমি নামটা বলি তিনি উত্তেজনায় প্রায় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন আরে ওটা তো আমাদের পাশের গ্রাম কোন বাড়ি? আমি জানাই, সেসব আমি কিস্যু জানিনা কারণ আমার পিতৃদেবও বড় হবার পর সেবাড়ি দেখেননি তবু আমার পদবি যখন এই, তখন সেই নামেই কোনও বাড়ি হবে হয়তো তিনি উচ্চস্বরে স্বগতোক্তি করেন, দে-বাড়ি, মানে লালবাড়ি আমি বলি, হয়তো... কারণ বাবার মুখে শুনেছি সেই বাড়িটা ছিলো লালরঙের তিনি বলে ওঠেন, আরে সেতো সেই বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার সুরেনডাক্তারের বাড়ি ছিলো সবসময় বন্দুকহাতে, পুলিশও ভয় পেতো আমি বলি, আপনি নিশ্চয় দেখেননি আরে না, আমি কী? আমার বাবাও দেখেননি তবে গপ্পোটা সেকালে সব্বাই জানতো তারপর তিনি গাঁয়ের লোক পেয়ে কামারাদোরিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন তৎক্ষণাৎ নেমত্তন্নো জানান সেই গ্রামে  তাঁর বাড়িতে অতিথি হতে আমিও পুলকিত হই নিজের গাঁয়ের লোক যদিও ঠাকুরদাদারা পুরুষানুক্রমিকভাবে আদত কলকাতার লোক, তবু জাতীয় গাঁ-গেরামের টান এক অন্য মাত্রা।




এটা হলো শিবের গীত তবে ধান ভানাটা কেমন, সেটা একটু বলি একেবারে শৈশবে আমার পিতৃদেব আর জ্যাঠামশাই বাবা-মার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যেতেন তখনও তাঁদের দশ ভাইবোনের মধ্যে শুধু তিনজনেরই জন্ম হয়েছে মানে গত শতকের তিরিশের দশকের প্রথমদিকে কখনও তা জামশেদপুর থেকে সেখানে যেতে গেলে ট্রেনে খড়্গপুর নেমে গাড়ি বদলে গড়বেতা ইস্টিশন। সেখান থেকে গরুর গাড়িতে গ্রামের বাড়ি, ফুলকুসমা, গোয়ালতোড় পেরিয়ে সেই পথে যখনই কোনও গ্রামের ভিতর দিয়ে গাড়ি পেরোতো, দাওয়ায় বসা গাঁয়ের গণ্যমান্যরা বলে উঠতেন, কে যায় ? কার বাড়ি ? আগেই বলেছি, ঠাকুরদা ছিলেন খুব সাহেবি স্বভাবের এইসব ব্যক্তিগত প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতেন না কিন্তু বারম্বার এইসব প্রশ্ন শুনলে তিনি বেশ গরম হয়ে যেতেন রাগ বেড়ে গেলেই উত্তরে তিনি বলে উঠতেন, "তোর বাপ" ঠাকুমা খুব অপ্রতিভ হতেন কিন্তু অভিজ্ঞ গ্রামবাসীরা বুঝে ফেলতেন, আরে নিশ্চয় সুরেন-ডাক্তারের ভাই

এতো গৌরচন্দ্রিকার অর্থ, সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে মানে, " কে যায়? কার বাড়ি?", শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন পল্লীতে অহরহ, এখনও




(ক্রমশ)